গল্প : রাকা মুখোপাধ্যায়

মঙ্গলবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২১ /
ফেসবুক-এ শেয়ার করুন /
টুইটার-এ শেয়ার করুন

 






 রাকা মুখোপাধ্যায়


অপেক্ষা এবং…



                                     এক

হরিহরণ বাবু প্রতিদিন সন্ধ্যে ঠিক ছ’টার সময় সিঁড়ির দিকে ওঁর ঘরের দরজাটা নিয়ম করে খুলে রাখেন,  আবার রাত নটায় বন্ধ করে দেন। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ওই একই কাজ একই ভাবে চলতে থাকে। একদিনও ভুল হয় না। 

বছর তিনেক আগে তৃতীয় বার সেরিব্রাল অ্যাটাক হয়ে যখন ভেন্টিলেশনে গেছিলেন, তখনই সবাই ভেবে নিয়েছিল - উনি আর ফিরবেন না। কিন্তু ছেলের জমানো সঞ্চয় এবং দামী ওষুধের শক্তিতে হরিহরণ বাবু বাড়ি ফিরলেন কিন্তু মস্তিষ্ক কোষ ক্রমশ কমজোরী হতে লাগল। 

অথচ... প্রতিদিন সন্ধ্যে ঠিক ছ’টায় দরজা খোলা এবং রাত ন'টায় দরজা বন্ধ করার অভ্যাসটা রয়ে গেল। প্রথম দিকটায় কয়েক মাস মনে ছিল কেন তিনি প্রতিদিন নিয়মিত ভাবে ঐ কাজটি করেন, কিন্তু ধীরে ধীরে মস্তিষ্কের মধ্যে কারণটা আবছা হতে লাগল। 

                                      দুই

দরজা খোলা বন্ধ করার  সঙ্গে সঙ্গে উনি আরও একটা অভ্যাস চালু রেখেছিলেন... প্রতিদিন সন্ধ্যায় মুড়ি-চানাচুর মেখে বসে থাকা... না, শুধুই বসে থাকতেন না... খেতেনও... মুড়ির  সঙ্গে কখনও চানাচুর, কখনও তেলেভাজা, কখনও সিঙারা...

পাঠকগণ ভাবতেই পারেন... বুড়ো মানুষ, খাবারের প্রতি লালসা থাকতেই পারে। হ্যাঁ, থাকতেই পারে... কিন্তু এক্ষেত্রে গল্পটা একটু অন্যরকম। 

                                    তিন

গল্পটা অন্যরকম... তার কারণ... হরিহরণ বাবু নিজেই বেশ খানিকটা অন্যরকম... সেই প্রসঙ্গে আসি।
একটু বরং ফ্ল্যাশব্যাকে যাওয়া যাক...

প্রায় অর্ধশত বছর আগে হরিহরণ বাবু বিয়ে করে তাঁর মায়ের জন্য দাসী এনেছিলেন।  কিন্তু ধীরে ধীরে তাঁর স্ত্রী বুঝতে পারলেন যে নতুন বৌয়ের প্রতি হরিহরণ বাবুর কোনই আকর্ষণ নেই। তবু সমাজের কাছে প্রমাণ সাপেক্ষে তাঁদের দুটি সন্তান হয়েছিল।  

সময়ের  সঙ্গে সঙ্গে বড় হতে হতে তাঁর সন্তানরাও বুঝতে পারল যে... হরিহরণ বাবু একটু অন্যরকম। তা, একজন মানুষ অন্যরকম হতেই পারেন,  স্ত্রীর সাথে তাঁর বনিবনা বা ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি নাই হতে পারে। আর এটাও খুব অস্বাভাবিক নয়... যে অন্য কারোর  সঙ্গে ওনার সম্পর্ক... হতেই পারে।

শেষমেষ যা বোঝা গেল... বেশ কিছু সম্পর্কের উত্থান-পাথানের পর হরিহরণ বাবু বেশ জোরালো এক সম্পর্কে নোঙর গেঁথেছেন.... বেশ কম বয়সী একজন। 

আর হ্যাঁ, সেই একজনের জন্যই  তিনি প্রতিদিন দরজা খুলে রাখতেন, সে আসত, একসঙ্গে বসে মুড়ি, সিঙারা,  তেলেভাজা,  চা... তারপর দরজা বন্ধ বেশ খানিকক্ষণের জন্য...দুজনের অন্তরঙ্গতা বন্ধ ঘরে.... তারপর সে চলে যেত।

                                     চার

দীর্ঘ বেশ কয়েক বছর ধরে চলেছিল এই অভ্যাস।  তারপর তৃতীয় বার সেরিব্রাল অ্যাটাকের পর যখন হরিহরণ বাবু নার্সিংহোমে, তখন থেকে তাঁর সেই ভালোবাসার মানুষটি আর কোনদিন আসল না তাঁর সামনে।

ভেন্টিলেশন থেকে ফিরেও হরিহরণ বাবুর প্রতিদিনের অপেক্ষা... শৈবাল ঠিক আসবে। হ্যাঁ, শৈবাল... শৈবালের জন্য দরজা খুলে রাখতে হবে,  মুড়ি মেখে রাখতে হবে... শৈবাল ঠিক আসবে, আসবেই। 

                                     পাঁচ

আজ হরিহরণ বাবু চলে গেলেন।  তাঁর দরজা চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে গেল। 

হ্যাঁ, হরিহরণ বাবু অন্যরকম ছিলেন.... নারী শরীরের প্রতি তাঁর কোনদিনও আসক্তি ছিল না।

 আর  ভালোবাসা... সে তো লিঙ্গ বিবেচনা করে না!  তাই এক অবিচল, অতল রহস্যের ভালোবাসা বোধহয় এরকমই অপেক্ষা নিয়ে থাকে... এক আমৃত্যু অপেক্ষা...