সম্পাদকীয় : শারদীয় শুভারম্ভ সংখ্যা

শনিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১ /
ফেসবুক-এ শেয়ার করুন /
টুইটার-এ শেয়ার করুন

 





বাংলার শারদ উৎসব
-----------------------------------------

গত দুবছর ধরে কোনও উৎসব পালনে মন নেই। এরমধ্যে পুনরায় আফগানিস্তানে অস্থির পরিবেশ
তৈরি হয়েছে। আমরা জানি এই অবস্থায় মেয়েদের নিপীড়িত হতে হয়। ওঁরা প্রতিবাদ করছেন, কিন্তু
কতদিন পারবেন? জানি না। শারদীয় সংখ্যার লেখালেখি নিয়ে না হয় একটু ভালো থাকলাম।

বাংলা কুটিরশিল্প নির্ভর রাজ্য। দুর্গাপুজোর সঙ্গে বেশ কিছু কুটিরশিল্প এবং লোকশিল্প জড়িয়ে
রয়েছে। যার অসামান্য প্রদর্শন দুর্গাপুজোয় ঘুরে ঘুরে প্রতিমা দর্শন করলে বোঝা যায়। প্রতিমা
নির্মাণ, চক্ষুদান, যা মৃৎশিল্পের ভাষায় রহস্য বা তপস্যা, আলোকসজ্জা, মণ্ডপসজ্জা সব বাংলার
লোকসংস্কৃতির পরিচায়ক। সাহিত্য এর প্রভাবমুক্ত না।

বীরভূম কৃষ্ণনগর এবং আজকের বাংলাদেশ সেদিনের পূর্ববঙ্গে ঝালোকাঠি পালঙ কাঁচাদিয়ায়
ছিল বিখ্যাত মৃৎশিল্পীদের বসবাস। তাঁরা শ্রাবণ মাস থেকেই বাঁধা-বাড়ির কাজে লেগে পড়তেন।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'প্রতিমা' গল্পে আমরা পড়ি মৃৎশিল্পী 'কুমারীশ মিস্ত্রী' একটি বাড়ির
প্রতিমা তৈরি করতে আসেন। বাড়ির ছোট বউ যমুনাকে দেখে ভাবেন, সাক্ষাৎ 'দুগ্গা-ঠাকুরন'।
যমুনার মুখের আদলে দুর্গার মুখ গড়েন। গ্রামের লোকজন দেখেন, গুঞ্জন শুরু হয়। বিজয়া দশমীর
দিন খিড়কির ঘাটে বউয়ের শরীর ভেসে ওঠে। যদিও পূর্ববঙ্গের বহু মৃৎশিল্পীই বলেন, তাঁদের
পরম্পরা সম্পন্ন বাড়ির নববধূর আদলে মায়ের মুখ তৈরি করা। যখন ছবি ছিল না, কষ্টিপাথরের 
পাত্রে জল রাখা হতো, জানলায় নববধূ দাঁড়ালে, সরাসরি না দেখে, জলে তার প্রতিবিম্ব দেখে মূর্তি
তৈরি করা হতো। আয়নার সামনে বসলে, সে প্রতিবিম্ব দেখেও করা হতো, যার সাবেকি নাম,
'ছবি-আয়না মুখ'।

'নয়নপুরের মাটি' সমরেশ বসুর উপন্যাসের 'মহিম'
পূর্ববঙ্গ থেকে কলকাতা আসা রমেশ পাল এবং কৃষ্ণনগরের গোপেশ্বর পালের অনুসারে লেখা কি?
গোপেশ্বর লর্ড কারমাইকেলের মুখ গড়ে সাহেবের সঙ্গে লন্ডন পাড়ি দেন। ওয়েম্বলি পার্কে প্রদর্শনীতে
মূর্তিও গড়েন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'একা এবং কয়েকজন' উপন্যাসে, ৪৬ সালে, ফরিদপুরের
মৃৎশিল্পী জলধর, বাড়ির ছেলে ডাক্তারি পাশ করা অতীনের পরামর্শে সম্পূর্ণ ঢেকে দুর্গাপ্রতিমা তৈরি
করেন। ষষ্ঠীর দিন সবাই দেখলেন, গণেশ লাল, লক্ষ্মী কাঁচা হলুদ, সরস্বতী দুধে আলতা (সেই
প্রথম), কার্তিকের বদলে সামরিক পোশাকে সুভাষচন্দ্র বসু! অসুর ব্রিটিশ মিলিটারি!

দেশভাগের পর পূর্ববঙ্গের শিল্পীরা এ পারে এসে কুমোরটুলিতে কাজ শুরু করেন। কেউ কেউ আর্ট
কলেজে প্রথাগত শিক্ষালাভ করেন। যেমন রমেশ পাল। ছোটবেলায় রমেশ পালের প্রতিমা দেখার
আগ্রহ ছিল অপরিসীম। অলোক সেনও ছিলেন দক্ষ ভাস্কর। তাঁর তৈরি প্রতিমাও খুব আকর্ষণীয়
ছিল। বকুলবাগানের পুজোয় আমরা দেখি ভাস্কর মীরা মুখোপাধ্যায়ের অনবদ্য প্রতিমা।বকুলবাগানে
ভাস্কর ঈশা মহম্মদের দুর্গা আজও সাম্প্রদয়িক সম্প্রীতির স্মৃতিচিহ্ন। বাঁকুড়ার ছান্দার থেকে
কলকাতা আসতেন ভাস্কর উৎপল চক্রবর্তী। তাপস দাস ধাতুনির্মিত মূর্তি এবং অলংকরণ
করতে কাটোয়া থেকে কলকাতা আসতেন। কয়েকবছর ধরে সনাতন দিন্দা প্রতিমা গড়ছেন।

ডাকের সাজ জরির কাজ বাঁশ মাদুর পোড়ামাটি ডোকরা কুটিরশিল্পের অভিনব কাজ দেখা যায়
দুর্গাপুজোয়। অপরাহ্ণ থেকে আলো জ্বলে ওঠে মণ্ডপে মণ্ডপে। হুগলি'র চন্দননগরের
আলোকশিল্পীরা নিপুণ কারিগরিতে তুলে আনেন সাম্প্রতিক যে কোনও ঘটনা। থিম পুজোর সঙ্গে
অভিনবত্ব সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে ।

সপরিবারে দুর্গা প্রতিমার পুজো ১৬১০ সালে সাবর্ণ চৌধুরীদের বাড়িতে শুরু হয়। অষ্টাদশ শতকে
বিদেশি সরকারের তাঁবেদারি জমিদার বাড়ির দুর্গাপুজোর লক্ষ্য হয়ে ওঠে। শোভাবাজার
রাজবাড়ির পুজোর নাম ছিল কোম্পানির পুজো। বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ এবং ১৯০৫-এ বাংলা ভাগ
দুর্গাপুজোয় বদল আনে। বাড়ির পুজো থেকে বারোয়ারি পুজো ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন
হিসেবেই শুরু হয়। প্রথম বারোয়ারি পুজো বাগবাজার সার্বজনীন ১৯১০ সালে। অষ্টমীর
লাঠিখেলা ছিল বীরত্বের প্রতীক।

পুজো মানেই পত্রিকার পুজোসংখ্যা। কোন প্রকাশনার পুজোসংখ্যা কত ভালো, তা নিয়ে
আলোচনা তর্ক আজও একরকম। কেশবচন্দ্র সেনের 'সুলভ সমাচার' ১২৮০ (বঙ্গাব্দ) আশ্বিন
মাসে 'ছুটির সুলভ' নামে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে। পরে 'বঙ্গবাণী' 'ভারতবর্ষ' প্রভৃতি পত্রিকা
শারদ সংখ্যা প্রকাশ করতে শুরু করে। প্রথম শারদীয় উপন্যাস 'বসুমতী' পত্রিকায় প্রকাশিত
হয়। আজ নিজে একটি ওয়েব পত্রিকার শারদ সংখ্যা করতে পারছি, আমার কাছে এর থেকে
অভাবনীয় আর কিছুই না।

প্রত্যেক লেখককে ১৪০০ সালের পক্ষ থেকে শারদীয়ার শুভকামনা জানাই।
---------------
তথ্য : আনন্দবাজার পত্রিকা, প্রভাত চৌধুরী, গুগল।