অলোকসামান্য অলোকরঞ্জন : স্বপন ভৌমিক

মঙ্গলবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২০ /
ফেসবুক-এ শেয়ার করুন /
টুইটার-এ শেয়ার করুন

 



অলোকসামান্য অলোকরঞ্জন
----------------------------------------
স্বপন ভৌমিক
--------------------

"There is no religion other than poetry, the
poetry of today will be tomorrow's religion"
উদ্ধৃতিটি কার আমার জানা নেই। আমার লেখার
সঙ্গে উদ্ধৃতিটি প্রাসঙ্গিক বলে উল্লেখ করলাম।

গত ১৭ নভেম্বর আমাদের ছেড়ে অমৃতলোকে চলে
গেলেন কিংবদন্তী কবি--বাংলা কবিতার যুবরাজ
অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। জার্মানির হাইডেলবার্গ
শহরে ৮৭ বছর বয়সে তিনি প্রয়াত হন। তাঁর মৃত্যু
সত্যিই এক নক্ষত্রপতন যা বৌদ্ধিক চর্চার জগতে
বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি করবে। তিনি ছিলেন বাংলা
কবিতায় "রেনেসাঁ" প্রজন্ম এবং আধুনিকতার
অন্যতম পথিকৃৎ। তিনি বাংলাভাষায় গ্যোয়েটে,
পল ভেরলেন, হেইন্ রিচ হাইনে, রেইনার মারিয়া
রিলকে, ব্রেশট প্রমুখের লেখার অনুবাদ করেন।
সোফোক্লিসের "আন্তিগোনে" নাটকটি ১৯৭৮ সালে
অলোকরঞ্জন বাংলায় অনুবাদ করেন এবং তা
কলকাতায় মঞ্চস্থ হয় Hangsgunter Heyme এর
দ্বারা। নাটকটি দর্শকদের অকুন্ঠ প্রশংসা লাভ
করে।

অলোকরঞ্জন শুধু কবিই ছিলেন না। তাঁর প্রতিভা
ছিল বহুমুখী। ১৯৬২-১৯৬৭ আমি যাদবপুর
বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্র
ছিলাম। ওই বছরগুলিতে তুলনামূলক সাহিত্যের
অধ্যাপক অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তকে খুব কাছ
থেকে দেখবার সুযোগ পাই। তিনি ছিলেন বিদগ্ধ
পণ্ডিত, কৃতী শিক্ষাবিদ, চিন্তাশীল প্রাবন্ধিক,
বিশ্বসাহিত্যের বরেণ্য গবেষক, কুশলী অনুবাদক,
ছাত্রদরদী নিরহংকারী জনপ্রিয় শিক্ষক। বেশ
কয়েকবার তাঁর lecture শুনেছি। বক্তৃতার মূল
লক্ষ্য হতো বিষয়ের গুরুত্বকে তুলে ধরা।
ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ওই বিষয়ে আগ্রহ জাগিয়ে
তোলা।

১৯৬২ সালে শঙ্খ ঘোষ ও অলোকরঞ্জনের যৌথ
প্রচেষ্টায় প্রকাশিত হয় "সপ্তসিন্ধু দশদিগন্ত" গ্রন্থটি।
এটি বিশ্বের বিভিন্ন ইংরেজি কবিতার বাংলা
অনুবাদ। বইটি বাংলা সাহিত্যের পরিধিকে বিস্তৃত
করে ও বাংলার পাঠকদের সঙ্গে পাশ্চাত্যের
লেখকদের পরিচিত হবার সুযোগ করে দেয়।
অলোকরঞ্জন সমন্বয়ের কবি, তাই ব্রেশট ও
চণ্ডীদাস তাঁর সাহিত্যের পরিমণ্ডলে মিলেমিশে
একাকার হয়ে যায়। ঈশ্বরচেতনা ও মানবচেতনার
ভিন্ন দুই ধারা এক পবিত্র সঙ্গমস্থলের জন্ম দেয়।
এর অনুঘটক হল মানবিকতা। "Humanity is the
real common thread which would go a
long way to bind people across the world".
"প্রেমে পরবাসে"(১৯৮৩), "অঙ্গীকারের কবিতা"
(১৯৭৭)  জার্মান থেকে বাংলায় তাঁর কুশলী
ভাষান্তর।

অলোকরঞ্জন আন্তর্জাতিকতা ও বিশ্বমানবিকতায়
বিশ্বাসী ছিলেন বলে জাতীয় গণ্ডি অতিক্রম করে
"প্রতীচী"(occident) ও "প্রাচ্য"(orient) দেশগুলির
মধ্যে সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানে সচেষ্ট ছিলেন।
তিনি বাংলা সাহিত্যের বহু বিষয় জার্মানে অনুবাদ
করেন। এভাবে জার্মান সাহিত্যের বাংলা ও
ইংরেজি অনুবাদের মধ্যে দিয়ে ভারতবাসীকে
জার্মান সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত করান। দুই দেশের
ভিন্নধরণের সংস্কৃতিকে একসূত্রে গ্রথিত করার
নিরলস প্রয়াসের স্বীকৃতিস্বরূপ জার্মানির গ‍্যোয়েটে
পুরস্কারে তিনি ভূষিত হন। 

১৯৫৯ সালে কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ "যৌবন বাউল"
প্রকাশিত হয়। কবিতার সংখ্যা ছিল একশোআট।
তাঁর কবিতার মুখ্য বিষয় ছিল প্রেম একাকিত্ব
প্রকৃতি ও ঈশ্বরচেতনা। কাব্যের ধরণ ছিল mystic.
এই বই থেকে কয়েকটি লাইন পড়া যাক-- "বন্ধুরা
বিদ্রুপ করে তোমাকে বিশ্বাস করি বলে/ তোমার
চেয়েও তারা বিশ্বাসের উপযোগী হলে/ আমি কি
তোমার কাছে আসতাম ভুলেও কখনো"। তাঁর
দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ "নিষিদ্ধ কোজাগরী" (১৯৬৭)
এই গ্রন্থে তাঁর চিত্তচাঞ্চল্য ও জীবনযাপনে শহুরে
মানসিকতার প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। "রক্তাক্ত
ঝরোখা" (১৯৬৯)। "ছৌ কাবুকির দেশে" (১৯৭৩)
"দেবীকে স্নানের ঘরে নগ্ন দেখে" (১৯৮৩) "সে কি
খুঁজে পেল ঈশ্বরকণা?" কবিকে বিংশ শতকের
অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাঙালি কবির শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান
করে। "মরমী করাত" গ্রন্থের জন্য ১৯৯২ সালে কবি
সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার পান। ১৯৬৯ সালে
তৃতীয় কাব্যগ্রন্থে পঁয়ত্রিশটি কবিতা হল "নির্বাসন"।
কবিতায় কবির গৃহকাতরতার(nostalgia) ছবি
সুস্পষ্ট হয়। কবির সর্বশেষ সংকলনটি প্রকাশিত
হয় ২০১৮ সালে।

ছন্দ নৈপুণ্য ও ভাষার অলংকরণ তাঁর কবিতাকে
ভিন্ন মাত্রা প্রদান করে। তিনি কাব্যের গঠনভঙ্গিতে
নানারকম পরিবর্তন এবং ছন্দ নিয়ে আজীবন
পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে গেছেন। শ্রেষ্ঠ কবিতার
উৎসর্গে তিনি লেখেন, "ভগবানের গুপ্তচর মৃত্যু
এসে বাঁধুক ঘর। ছন্দে আমি কবিতা ছাড়ব না"।
এর সঙ্গে বিশ্বমানবিকতা বৈদগ্ধ অনুভব যুক্তি
কবির কবিতাকে দিয়েছে ব্যাপ্তি ও সুষমা। একজন
বিশ্বনাগরিক হিসেবে আন্তর্জাতিকতা ও সার্বিক
অন্তর্ভুক্তিকরণের (inclusivity) আদর্শের দ্বারা
কবি ঋদ্ধ হন। তাঁর কবিতার ভরকেন্দ্রে আছে
মানুষ, বিশেষ করে সমাজে যারা অবহেলিত। তাঁর
কবিতায় বারবার এঁদের কথাই বলা, এঁরাই কবির
কাছের মানুষ। "জানো এটা কার বাড়ি? শহুরে
বাবুরা ছিল কাল,/ ভীষণ শ্যাওলা এসে আজ তার
জানালা দেয়াল/ ঢেকে গেছে, যেন ওর ভয়ানক
বেড়ে গেছে দেনা,/ তাই কোনো পাখিও বসে না!/
এর চেয়ে আমাদের কুঁড়েঘর ঢের ভালো, ঢের/
দলে-দলে নীল পাখি নিকোনো নরম উঠোনের/
ধান খায়, ধান খেয়ে যাবে--/ বুধুয়া অবাক হয়ে
ভাবে।" এই কবিতাপাঠে পাঠকের মনে এক অনন্য
অনুরণন তৈরি হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে
মুখোমুখি হলে অধ্যাপক দাশগুপ্ত ছোট্ট করে
হাসতেন, হাসিতে তাঁর স্নেহাশীর্বাদ ঝরে পড়ত।
তাঁর রসবোধের একটি কবিতা দিয়ে স্মৃতির
উদ্দেশে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই:

শূন্যতা যখন পূর্ণ/ অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত

আমার মায়ের মৃত্যুর পর
কাতারে কাতারে লোক যখন সান্ত্বনা দিতে এল
মুখ ফুটে একটিও কথা বলতে পারল না।

দুয়েকজন মূর্খ সুপণ্ডিত
এরই মধ্যে শাস্ত্র ছেনে স্তোকবাক্য সাজাতে গিয়ে
স্মিত/
তোতলামি করলেন খুব, সে এক মহান বিড়ম্বনা।

তাদের থামিয়ে দিতে গিয়ে
ঘামে নেয়ে উঠি, আর অতঃপর অনর্গল আমি
কথার ঝরনায় বাকি সকলের সন্তাপ জুড়িয়ে

নিঃশব্দে গ্রহণ করি ওদের উচ্ছল দান, আম,
আপেল, বাতাবি লেবু, শূন্য ঘর ছাপিয়ে গিয়েছে

অসময়ে একসঙ্গে এত ফল কখনো দেখিনি...
----------