ধারাবাহিক : সন্দীপন গোস্বামী

সোমবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০২০ /
ফেসবুক-এ শেয়ার করুন /
টুইটার-এ শেয়ার করুন

 



বিস্মৃত পটুয়া (১)

 

ছাপাই-ছবির সম্রাট

 

তখন তেলরঙের কাজ নিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন তাবড় 

পেন্টাররা। তিনি কিন্তু ব্যতিক্রম। তিনি ডুবে ছেনি-হাতুড়ির

 সেই কোনকালের পুরনো কৌশলে। স্বর্ণকার, কর্মকারদের

 হাতে তৈরি ছাপাই ছবির আদি কারিগরদের মন্ত্রই তাঁর সব।

 যাকে বহুকাল বটতলার ছবি বলে গালমন্দ করা হয়েছে। 

পরোয়া করেননি তিনি। অসাধারণ নৈপুণ্যে ফুটিয়ে তুলেছেন 

একের পর এক বিষয়। যার বেশির ভাগই গ্রাম বাংলার 

আত্মা থেকে তুলে আনা। কোথাও বৃষ্টির পরে গ্রাম্য মেয়ে 

তার বন্ধুটিকে নিয়ে পুকুরে ছিপ ফেলে বসে আছে। কোথাও

 আলোছায়ার অদ্ভুত মায়াজাল তৈরি করে তাল গাছেদের

 নীরবতাতেও কত কী যেন বলা হচ্ছে। তাঁর নিমগ্ন-সৃষ্টির

 তালিকা সুদীর্ঘ। ছবিতে কোথাও হাল্কা রঙের বাহার। কোথাও

 সাদা-কালোর আশ্চর্য প্রয়োগ। তাঁর কাজের বিস্তার ও নিবিষ্টতা

 মোহিত করত দর্শককে। তিনি হরেন্দ্রনারায়ণ দাস। খানিক 

সংক্ষেপে হরেন দাস। আজকের ক’জন আর তাঁকে মনে রেখেছেন।

 সাবেক ও পার বাংলার দিনাজপুরে জন্ম ১৯২১-এ। প্রয়াণ গত 

শতাব্দীর নয়ের দশকের গোড়ায়। একটা সময় উডকাট আর 

কাঠ খোদাইয়ে তিনি ছিলেন সম্রাট। কম যেতেন না এচিং বা 

লিনোকাটে। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে যেত তাঁর কাজে তৈরি হওয়া 

আলো-আঁধারি আবেদনে। তাঁর ছবির মেজাজ যেন রবীন্দ্রনাথ 

বা বিভূতিবাবুর কলমে প্রকৃতিবর্ণনার চিত্ররূপ। এবং তা অনেকটাই 

কবিতাধর্মী। পাঁচ ও ছয়ের দশকে তাঁর ছবির অনেক প্রদর্শনী 

হয়েছে। দেশে ও বিদেশে। কাজ দেখলেই বোঝা যেত, পূর্ববঙ্গের 

গ্রামীন জীবনের স্মৃতি কতটা তাড়িত করত তাঁকে। শিল্পী হরেন 

দাসের পিতৃবিয়োগ হয় তাঁর জন্মের আগেই। পৃথিবীর আলো দেখতে 

না দেখতেই চিরঘুমে চলে যান তাঁর মা। মানুষ হয়েছেন 

কাকা-কাকিমার কাছে। কী আশ্চর্য, পরিবারই আন্দাজ করেছিল 

তাঁর প্রতিভা। কারণ ছোটবেলা থেকেই তাঁর ছবি আঁকার নেশা। 

দেওয়াল, মাটি, স্লেট— যেখানে পারতেন সেখানেই আঁকতেন। 

অসম্ভব ভালবাসতেন নিসর্গচিত্র আঁকতে। নিশ্চয়ই একটা কবি-মন 

লুকিয়ে ছিল তাঁর মনে। এবং স্কুলের পড়া শেষ করেই আর্ট কলেজে 

ভর্তি হওয়ার অনুমতি পেয়েছিলেন। যা তাঁর জীবনের মোড়ই বদলে 

দেয়। এতটাই কৃতী ছাত্র ছিলেন, যে আর্ট কলেজের গ্রাফিক্স বিভাগে 

পরবর্তী কালে তিনি শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এমন নয় যে 

নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার এই সময়কালটা খুব মসৃণ ছিল। কলকাতায় 

রাতে শুতে পারবেন বলে কাজ করেছেন লন্ড্রিতে। দু’চার টাকা 

উপার্জন করে অন্নসংস্থান নিশ্চিত করতে দর্জির দোকানে জামায় 

বোতাম লাগানোর কাজ পর্যন্ত করেছেন। কিন্তু শত কষ্টেও তাঁর 

সেই আসল ভালবাসার জায়গাটা অর্থাৎ ছবি আঁকার নেশাটা কিন্তু 

যায়নি। একেবারে শেষ বয়সে ১৯৮৯-তে কিছুটা স্বীকৃতিও পেয়েছিলেন। 

সে বছর তাঁকে দেওয়া হয় অবনীন্দ্র পুরস্কার। তার আঁকা গ্রাম বাংলার 

জীবন থেকে তুলে আনা ছবি আর শহুরে খেটে খাওয়া মানুষদের 

চিত্ররূপ এতটাই জনপ্রিয় ছিল, যে সে সময় রঙের দোকানে পর্যন্ত 

তাঁর ড্রয়িংয়ের বই বিক্রি হত।

 

সন্দীপন গোস্বামী