কবিতা : মানস চক্রবর্ত্তী

 





মানস চক্রবর্ত্তী  


কত কিছুই ভুলিনি 
     

আমার এক বন্ধু ছিল 
তার নাম অনিন্দিতা 
তাকে আমি ভুলিনি 
অথচ ভুলে যাওয়ার কথা ছিল | 
শেষ বিকেলের বিদায় বেলায় সে বলেছিল , 
" পারলে আমায় ক্ষমা করো 
 না পারলে ভুলে যেয়ো | " 
আমি কোনোটাই পারিনি |  




আমার বাবা 
স্মরণীয় , বরণীয় কেউ ছিলেন না ; 
আইনজীবী , চাকুরীজীবী , ব্যবসায়ী ,
 বুদ্ধিজীবী,লেখক , আঁতেল কিছুই ছিল না ; 
কোনো কিছুই তেমন বাগিয়ে গুছিয়ে বলতে পারতেন না 
কেবল বলতে পারতেন রবীন্দ্রনাথ আর জীবনানন্দ 
সন্ধ্যার ঠিক আগে নদীর ধারে দাঁড়িয়ে আপন মনে গাইতেন ,  
" ওগো, তুমি কোথা যাও কোন্ বিদেশে ? 
বারেক ভিড়াও তরী কূলেতে এসে | 
যেয়ো যেথা যেতে চাও , যারে খুশি তারে দাও -
শুধু তুমি নিয়ে যাও ক্ষণিক হেসে 
আমার সোনার ধান কুলেতে এসে || " 
আমার মনে হতো বাবা প্রার্থনা করছেন 
বাবার সঞ্চিত ধন কিছু কি ছিল ? 
বাবাকে কিছু জিজ্ঞাসা করলে বলতেন , 
" ঐ আমাদের একটা কিছু হয়ে গেল | " 
কি হয়ে গেল ? কার সঙ্গে ? 
শুধু ঐ হয়ে যাওয়ার আহ্লাদটুকু 
আমি ভুলতে পারিনি | 




আমার মা সেই অর্থে ছিল অভিজাত 
বাবা ছিল পরিপূর্ণ বেকার 
আর বাবাকে বউ এ নয় , বই এ গিলিয়াছিল 
এইরকম একটা মানুষকে আগলে রাখা , সামলে রাখা , আলোকে রাখা ,
শুধু ব্যয়সাধ্য নয় , শ্রম সাধ্যও | 
বাবার সঙ্গে মায়ের বিয়েটা শুধু বয়ঃসন্ধির দোষ ছিল না 
আমার মা এতটা লঘু মস্তিষ্কের মহিলা ছিলেন না 
রিপু ইন্দ্রিয়ের তাড়নায় অথবা 
রুপের জৌলুসে বিবাহে আমি দেখেছি 
প্রতিশ্রুতির সংস্কার ভাঙলে তা অন্ধকারের মতো কালো হয়ে যায় | 
বাবার অলস বসে থাকা অথচ মায়ের বেজার মুখ 
আমি কোনোদিনও দেখিনি |  




স্কুল থেকে ফিরে কাপড় বদলে 
মা বাবাকে গান শোনাতে বসতেন 
মা প্রায়ই গাইতেন , 
" তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা , তুমি আমার সাধের সাধনা , 
মম শূন্যগগনবিহারী | 
আমি আপন মনের মাধুরী মিশায়ে তোমারে করেছি রচনা 
তুমি আমারি , তুমি আমারি ...." 
বাবা নিঃশব্দে চেয়ারে আধশোয়া অবস্থায় ..... 




মা কোনোদিনও অপেক্ষা করেনি 
দাদুর উপেক্ষা পরবর্তী জীবনের জন্য , 
আবার রক্ষণশীল শ্বশুরের রক্ষণশীলতাকে 
জীবনের জন্য কম্পালসারি বলে ভাবতেও পারেননি,
অথচ মাকে আমৃত্যু কোনো অভিযোগ করতে শুনিনি 
মানুষ যেভাবে মহিয়সী মহিলাকে মনে রাখে 
আমি আমার মাকে সেভাবেই মনে রাখব |