সম্পাদকীয় : ১৪০০ সাল বৈশাখ সংখ্যা

 





সম্পাদকীয়

গরম একটু বেশিই এ বছর। ভ্যাপসা গরম এবং ঘাম কাজের জন্য অনুকূল না। বৈশাখ সংখ্যা
প্রকাশে দেরি হওয়ার জন্য অবশ্য উষ্ণ আবহাওয়া দায়ী না। কিছু ব্যক্তিগত কাজে ব্যস্ততা এর কারণ।

গত সংখ্যায় কয়েকজনকে নিয়ে স্মরণলেখ প্রকাশিত হয়েছিল। এ সংখ্যায় সুরকার বাপ্পি
লাহিড়ীকে শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে। খুব প্রিয় দুই খেলোয়াড় সুরজিৎ সেনগুপ্ত এবং ক্রিকেট
লিজেন্ড শেন ওয়ার্নকে নিয়ে কিছু কথা বলতেই হয়। বিশেষ করে বরাবর স্পোর্টস আমার প্রিয়
বিষয়।

খুব ছোট থেকে ক্রিকেট কমেন্ট্রি শোনা অভ্যাস। বড়ো হয়ে মাঠেও গিয়েছি। ক্রিকেট এবং অন্য
খেলার উপর সিনেমাও দেখেছি। ভারতীয় দলে সেই সময় স্পিন বোলিং এবং বোলাররা সম্পদ।
ফাস্ট এবং মিডিয়ম পেসারদের বুঝতে সময় লেগেছে। বেদী চন্দ্রশেখর প্রসন্ন ভেঙ্কটরাঘবন
ছিলেন খুব পছন্দের। ফাস্ট বোলিং এ যেমন উন্মাদনা আছে স্পিন বোলিং এর অদ্ভুত এক
শৈল্পিক আকর্ষণ আছে। সেই শিল্পকে সবথেকে উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন আমার দেখা সর্বকালের
সেরা স্পিন বোলার শেন ওয়ার্ন। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট বরাবর অনুশীলন অনুসারী। অধিকাংশ
ক্রিকেটার সঠিক সময়ে ফর্মে থাকতে থাকতে অবসর নেন। স্পিড কমে গেলে বয়স হয়ে গেলে
কোনো দু চারটি টেকনিক্যাল স্কিল ভরসা করে খেলা আঁকড়ে পড়ে থাকেন না। অবসর কিন্তু
একটা অনুশীলন।

শেন ওয়ার্ন কি সত্যি মেনে চলতেন এই তথাকথিত অস্ট্রেলীয় অনুশীলন? মনে রাখতে হবে তাঁর সময়
তিনি এবং বেশ কয়েকজন অসামান্য ক্রিকেটার অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেটকে এমন উচ্চতায় পৌঁছে
দিয়েছিলেন, অন্য দলের পক্ষে অস্ট্রেলিয়াকে হারানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। অস্ট্রেলিয়া
দল নিয়ে এমন প্রবাদ চালু ছিল, কোনো তুখোড় ব্যাটসম্যান যদি সেঞ্চুরির আগে রানিং বিটুইন দ্য
উইকেটে ইচ্ছে করে সামান্য স্লো হয়ে যেতেন, বা দু একটা রান সহজে এলেও না নিয়ে ল্যুজ বলের
অপেক্ষা করতেন, দিনের শেষে তিনি যত রান করুন না কেন, তাঁকে টিম ম্যানেজমেন্টের প্রশ্নের
সম্মুখীন হতে হতো। এই অনুশীলনকে বুড়ো আঙুল দেখানোর মতো মগজ় নিয়ে বোধহয় ওয়ার্ন
জন্মেছিলেন। লেট নাইট, চূড়ান্ত উচ্ছৃঙ্খলতা, সব গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের আগের দিন রাতে ঘটিয়েও কী
অমোঘ প্রতিভায় তিনি মাঠে নিজের একশো শতাংশ দিতে পারতেন তা রহস্য।

রহস্য তাঁর অনবদ্য ফ্লিপার এবং ব্যাকস্পিনে, তাঁর আকস্মিক মৃত্যুতেও। যে বলে তিনি গ্যাটিং এর
অফস্টাম্প উড়িয়ে দিয়েছিলেন, তা আজও স্বপ্নের মতো চোখে ধরে রেখেছি আমরা। লেগস্টাম্পে
পিচ পড়েছিল বলটি। আমরা অবাক, মাইক গ্যাটিংও অবাক হয়ে দেখছিলেন! ওয়ার্ন প্রথম
বিশ্বের গতিময় পিচে খেলেও উপমহাদেশের মতো সূক্ষ্ম কারুকাজের স্পিন বোলিং করতে
পেরেছিলেন। ক্রিকেটের বাইরে তাঁর জীবন ছিল উদ্দাম রকস্টারের মতো। কিছুটা ফুটবল
ম্যাজিশিয়ান মারাদোনার সঙ্গে তুলনা করা চলে। তবে মারাদোনা ছিলেন তৃতীয় বিশ্বের প্রতিনিধি।
দুজনেই খুব তাড়াতাড়ি চলে গেলেন। জীবনের জমা খরচের হিসাব বোধহয় এরকমই। বিদায় শেন
ওয়ার্ন, আপনি জীবনকে জীবনের থেকে বেশি ভরিয়ে রেখে আমাদের অকৃপণ আনন্দ দিয়ে চলে গেলেন।





শেন ওয়ার্নের মতো ভারতীয় এবং বাংলা ফুটবলে আমাদের সময় সবথেকে জনপ্রিয় সুরজিৎ
সেনগুপ্ত খেলতেন মেধা এবং মগজ় দিয়েই। তবে তিনি ছিলেন আপাদমস্তক ভদ্র শিক্ষিত এবং
একেবারে অন্যধরনের মানুষ। ফুটবলের বাইরে তিনি নিয়মিত ধ্রুপদি সংগীতের চর্চা সাহিত্যচর্চা
চালিয়ে গিয়েছেন। আমাদের প্রজন্ম চুনী গোস্বামীর খেলা সেভাবে দ্যাখেনি। শিল্পী ফুটবলার
মানেই সুরজিৎ সেনগুপ্ত। কলকাতা ময়দানে আমার দেখা শিল্পী খেলোয়াড়ের বাকি দুজন, যদি
আমি ভুল না করি, মজিদ বাসকর এবং কৃশানু দে। মজিদ ছিলেন বিদেশি খেলোয়াড়।

সুরজিৎ প্রথম যিনি আমাদের জ়িরো অ্যাঙ্গেল থেকে গোল করা যায় দেখিয়েছিলেন। তাঁকে
আটকাতে গিয়েই ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে সেই পাঁচ গোলের কলঙ্ক বয়ে বেড়াতে হয়েছিল
মোহনবাগানকে। ওঁর ফুটবল প্রতিভা নিয়ে বলার মতো দক্ষতা আমার নেই। কিন্তু বলতে ইচ্ছে
করছে বিশ্ব ফুটবলে ওই সময় আমরা দেশ হিসেবে যথেষ্ট পিছিয়ে। কিন্তু যখনই আন্তর্জাতিক কোনো
দল বা ক্লাবের সঙ্গে খেলা হয়েছে ভারত বা সুরজিতের ক্লাব হেরে গেলেও সুরজিৎ খেলায়
আলাদা করে নিজেকে ঠিক তুলে ধরেছেন। পাখতাখোর, আরারত, ব্যাংকক পোর্ট অথরিটি,
দক্ষিণ কোরিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় একাদশ, সবার বিরুদ্ধে সুরজিৎ ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। হার জিৎ
যাই ঘটুক না কেন। অফ দ্য বল খেলাতেও ভারতীয় ফুটবলে সুরজিৎ সেনগুপ্ত উল্লেখযোগ্য
এক নাম। গেমসম্যানশিপ দিয়ে দু তিনবার তাঁকে আটকানো গেলেও, অধিকাংশ সময়ে তা কাজে
আসত না।

প্রবাসী বাঙালিদের কাছে সুরজিৎ ছিলেন অসম্ভব জনপ্রিয়। একটি গল্প আছে দিল্লি রেল কাউন্টারে
এক বাঙালি ভদ্রলোক টিকিট কাটতে গিয়ে দেখলেন, কলকাতাগামী কোনো ট্রেনে একটিও
টিকিট নেই। বিমর্ষ হয়ে তিনি বললেন, হায় রে কলকাতা যাচ্ছিলাম সুরজিতের খেলা দেখতে।
টিকিট কাউন্টারের ভেতরে বসা মানুষটি বললেন, দাঁড়ান, এই নিন একটা টিকিট। ফিরে এসে
আমাকে বলবেন কেমন দেখলেন সুরজিৎ সেনগুপ্তের খেলা! সুরজিতের জন্যই মহিলা
ফুটবলপ্রেমীরা একটু বেশিই মাঠে যেতে শুরু করেন। কলকাতা ফুটবল মাঠের পরিবেশ মহিলা
দর্শকদের জন্য অনুকূল ছিল না, তবু এই পরিবর্তন ঘটেছিল। আমি একজন উচ্চপদস্থ অফিসারের
স্ত্রীকে চিনতাম, যিনি সুরজিতের পেপার কাটিং এর  অ্যালবামসহ মাঠে গিয়ে বসতেন! সুরজিৎ তাঁর
ভক্তদের সঙ্গে মার্জিত ব্যবহার করতেন।

রবার্তো কার্লোস রোনাল্ডিনহো বেকহ্যামদের দূরপাল্লার শটে গোল দেখার আগেই আমরা
সুরজিৎ সেনগুপ্তকে দেখেছি, বাঙালি এবং ভারতীয় হিসেবে গর্বের সঙ্গে বলতে পারি। ড্রিবল,
সোয়ার্ভিং শট, নিখুঁত পাস, গেম প্ল্যানিং-এ সুরজিৎ সেনগুপ্ত ছিলেন অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফুটবলার। ফুটবল
আঁকড়ে তাঁর জীবন থেমে থাকেনি। অসাধারণ গান গাইতেন তিনি, তবলা বাজাতেন। রীতিমতো
সাহিত্যচর্চা করতেন। গল্প উপন্যাস কবিতার একনিষ্ঠ পাঠক ছিলেন সুরজিৎ। ইন্টেলেকচুয়াল
ফুটবলার এই নামে তাঁকে বিশেষিত করা হয়ে থাকে। সুরজিতের এত তাড়াতাড়ি চলে যাওয়ায়
ফুটবলপ্রেমী হিসেবে আমরা শোকস্তব্ধ। আপনাকে আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাই।

বৈশাখ সংখ্যা প্রকাশে দেরি হওয়ার জন্য দুঃখিত
--------------