পাখিরহস্য ও একটি বিপ্ শব্দের আয়োজন
বিশ্বজিৎ দাস
১.
থমথমে গ্রাম। এই তো সেদিন ছিল
মদের আসর আর ফূর্তির আদর
হঠাৎ করেই এল কালোমেঘ, শোর্ড
পাখিটি গাইল কু,
তারপরেই উড়ল—
ত্রিমোনীর চরে দুটি মুখবাধা বস্তা
ভেসে উঠে আটকে আছে, খবর ছড়ায়
লোকমুখে; সন্দেহ হওয়ায় পুলিশকে
ডেকেছে গ্রামের মাতব্বর। বস্তা খুলে
দেখেছে কোচানো মাংসের সঙ্গেই মুণ্ডু...
২.
পাখিটি পুষেছে অজয় আর অভয়।
বড় শখ করে এনেছে শালিক, তারা
মাথাভাঙা নারিকেল গাছে উঠে গর্তে
হাত দিয়ে বের করে, তারপর তাকে
নিয়ে শিখিয়েছে মানুষের বোল; কথা
জলকরে থেকে দুজনে এসব করে
ঘেরের মাছের চাষে ওরা পটু, তাই
মালিক বেসেছে ভালো মুঠো মুঠো টাকা
দিয়েছে ওদের, তবু মুখের হাঁ বড়
গিলেছে নিজেদেরই সব আয়ুরেখা...
৩.
অনেক কথাই বলতে শিখেছে পাখিটি
অজয় অভয় হাসে, হয়েছে ওস্তাদ
সংকেতে ইশারায় ডাকে; প্রাণভ্রমর―
বাগদা চিংড়ি ব্যবসায় আনিসুর আসে
ধ্বনিপুর গ্রামে। শুরুতে লাভের মুখ
দেখেই ওদের বলেছে কি চাই বলো?
মাসমাইনে বাড়িয়ে সঙ্গে মদের স্টক
খাও, কত খাবে; যেন বিশ্বাস খেয়ো না...
৪.
বাঁজপড়া ভাঙা গাছ থেকে শালিকের
শাবক এনেছে ওরা,
পাখি যেন চর!
কখন উড়েছে সুখ ঘুমের আড়ালে―
হ্যাচারি উজাড় করে পিন বাগদা যাচ্ছে
অন্যের চেম্বারে শুধু জলের বিষাদ
ভাইরাসে মাছ মরে, এই অজুহাতে
মালিকের মন জোগায়; সেও বুঝেছে
৫.
দিনে দিনে পাখিটি বুঝেছে সে আসলে
জ্যোত্স্না রঙের ঘুম, ঝুপ করে আসবে
এই আকাশের গায়ে, মাটির ভিতরে
কথাবলা আর কতক্ষণ?
হেসেছে বাতিটি―
সন্দেহ ক্রমেই বাড়ে, চুরির মাত্রাও
আনিসুর আসে পূর্ণিমার গনমুখে
ওদের জানায় আজকে একসাথে মদ খাবে,
রাতে থেকে দেখবে; মাছের কি হাল
কে জানত যে, সেই রাত হচ্ছে শেষ রাত!
৬.
উড়ে গেছে অলীক পাখিটি। আলাতেই
কেটেছে দিনের পর দিন, এখন সে
আদালত চত্তরে বেধেছে বাসা। গাছে
বসেই দেখেছে, আইনের বোল শিখছে;
তার মতো কত মানুষেরা―
কোঁচানো লাশের থেকে মুণ্ডু তুলে নিয়ে
আগেই পুলিশ ঠিক শনাক্ত করেছে
অজয়, অভয়ের বাড়ির লোক আসে
কান্নায় ভেঙেছে পড়ে, সন্দেহজনক
আনিসুরের নামই করেছে ওরা, তার
শাস্তির দাবীতে লেখে এফ.আই.আর
৭.
উঁকিঝুঁকি মেরে দেখে ওদের পাখিটি
পুলিশের গাড়ি আসে, আসামীরা নামে
টি-ক-ও টি-ক-ও করে ডাকে; বোল ভুলে―
নিরুদ্দেশ আনিসুরেরা পড়েছে ধরা,
ধ্বনিপুরের জঙ্গলে
কেওড়ার বনেই
জেরায় করেছে স্বীকার, তারাই মেরে
নদীর জলেতে ভাসিয়ে দিয়েছে; কেন
তাকে নিঃস্ব করেছে ওদের এই লোভ?
৮.
একটা অশ্বত্থের ডালে বসে, পুচ হাগে
বিচারকের মাথায় পড়ে; পুলিশেরা
হুশ হুশ করে আর হাসে চোখটিপে!
মামলার মেরিট দেখে জজসাহেব
দিয়েছেন রায়, চোদ্দ দিন হেফাজত
ডবল মার্ডার কেস-এ পুলিশ কাস্টোডি
পুরোপুরি বদলে গেল, চোদ্দ দিন পরে
বেকসুর খালাসের কপি নিয়ে হাসল...
৯.
পাখিদের একটা দল তৈরি করেছে সে।
ওরা আইনের ভাষা বুঝেছে, বলেছে
কা-ঠ-ঠ-গো-ওড়া-ওড়া-য় ও-ঠ ও-ঠ-ঔ―
এরমধ্যেই নতুন করে কেস হল,
এবার পুলিশ আরও চাপ টাকা চেয়ে
আনিসুর ও তার সঙ্গীকে; খুন ওসি!
তারপর বিস্তর তল্লাসি করে ধরে
এনকাউন্টার আনিসুরের সঙ্গীকে―
১০.
পাখিটি অনেক ভেবে আবার উড়েছে
কু গেয়ে, পালকে বৃষ্টি দিয়ে ধুয়ে; ভাসে
সময়ের গোলাপি রঙের খুব কাছে...
নতুন করেই কেস সাজায় পুলিশ
নতুন পুরনো মিলে জবানবন্দির
রেকর্ড করেছে ওরা। সেখানে বলেছে
আনিসুর, সারারাত মদ খাইয়ে
কিভাবে ঘুমের ঘোরে শোর্ড দিয়ে
প্রথমে আলাদা করে মাথা থেকে ধড়
তারপর, কুচি কুচি করে বস্তা ভরে
নদীতে ফেলেছে; ওসিকেও মেরেছে প্ল্যান মাফিক!
সংলাপ বয়েছে রক্তে, দু’হাতে তখন
মাটির শিকড় খুঁজে আর্তনাদে আঁকড়ে
এই পৃথিবীর গায়ে রাখে ছোট্ট ফুলস্টপ; বিপ্―
পাদটীকা :
১. জলকর ও ঘের সমার্থক।
যেখানে বাগদা চিংড়ি ও সাদা মাছ(ভেটকী, পারসে ইত্যাদি) চাষ করা হয়।
২. হ্যাচারি – যেখানে একেবারে ছোটো বাগদা চিংড়ির পরিচর্যা করা হয়।
৩. পিন বাগদা – আলপিনের চেয়েও সরু মাছ।
৪. চেম্বার – যেখানে পিন বাগদা ছেড়ে একটু বড়ো করা হয়।
৫. কেওড়া – সুন্দরবনের একটি গাছ। এর ফল টক হয়। মানুষ খায়ও।
কোন মন্তব্য নেই
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন