গল্প : রিতা মিত্র

 



বন্ডিং
---------
   
রিতা মিত্র
--------------


কয়েকদিন ধরে নাগাড়ে বৃষ্টি হয়েই চলেছে।
থামবার  নাম নেই। এমনিতেই শ্রাবণ মাস। তাই
আকাশের ছিঁচকাঁদুনি ভাব।
নিউটাউনে উঁচু বিল্ডিং গুলির একটিতে মৈত্রেয়ীর
ফ্ল্যাট।  বারো তলায়। তার ফ্ল্যাট থেকে চারদিকে
দেখা যায়। কত ছোটো বড়ো ফ্ল্যাট, বাড়ি, ব্যস্ত
রাস্তা ঘাট। তবুও মৈত্রেয়ীর দৃষ্টি সেই দূর দিগন্তের
দিকে। কী জানি কী দ্যাখে, কী খোঁজে।
অঝোর বৃষ্টি বাইরে, আজ মৈত্রেয়ীর কলেজ ছুটি।
বাড়ি, ঘরদোর পরিস্কারে লেগেছে। সবকটা ঘর
পরিস্কার করে এখন ডাইনিং রুমে এসেছে। 
ডাইনিং রুমের পুব দিকের দেয়াল পুরোটা কাচের।
এখানে বসে সে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে থাকে।
কতক্ষণ ধরে কাপড় দিয়ে কাচগুলো ঘসছে তবুও
আবছা দেখাচ্ছে বাইরেটা। আবার ঘসছে। ফ্ল্যাটের
দরজা খোলার শব্দ পেয়েই মৈত্রেয়ী বুঝেছে, মিঠি
এসে গেছে।
'মা'
মিঠির দিকে না তাকিয়েই মৈত্রেয়ী বলে উঠল,
'ভিজে এসেছিস। কাপড় ছেড়ে নে। আমি চা
আনছি।'
'মা বৃষ্টি কখন থেমে গেছে। এখন বাইরে ঝকঝকে
রোদ্দুর।'
এই বলে মিঠি নিজের ঘরের দিকে চলে যেতে গিয়ে
থেমে যায়। ব্যাগটা কর্নার টেবিলে রেখে মৈত্রেয়ীর
কাছে এসে তার কাঁধ ধরে , তার থুতনি তুলে মিঠি
বলে উঠল, 'আমাকে বাইরের ঝড়ঝঞ্জা ভেজাবে
তার সাধ‍্যি নেই, আমাকে ভিজিয়ে দেয় তোমার
চোখের এই ধারা।'
'আর কত মা?'
'ছাড় চা করে আনি।'
'না তুমি বসো, আমি চা করব। জাস্ট গিভ মি
ফাইভ মিনিটস।'
মেয়ের কাছে হার মেনেও আনন্দ। একটা চেয়ার
নিয়ে বসে মৈত্রেয়ী। সত্যি তো এখন বাইরে হলুদ
রোদের ঝলকানি। দূরে তাকিয়ে দেখতে দেখতে
আবার হারিয়ে যায় মৈত্রেয়ী। এমনই এক
শ্রাবণদিনে, কলেজ থেকে ফেরার পথে পাপিয়ার
বাড়ি কিছু নোটস নিতে গিয়েছিল। বেরোতে
বেরোতে সন্ধ্যা সাতটা বেজে গিয়েছিল। ফেরার
কথা শুনে পাপিয়ার মা বলেছিলেন আজ রাতটা
থেকে যাও। যা বৃষ্টি হচ্ছে। বাড়িতে একটা ফোন
করে জানিয়ে দাও, তাহলেই হবে। কিন্তু মৈত্রেয়ী
শোনেনি সে কথা। বৃষ্টিটা একটু কমে আসতেই সে
বাড়ি ফিরবে বলে বেরিয়ে পড়ে।
বড়ো রাস্তা এসে বাস বা অটোর অপেক্ষা করছে।
কিছু পাচ্ছে না। এদিকে আবার বৃষ্টি নেমেছে।
জোরে। এবার উপায়! ছাতা নেই কাছে। যানবাহন
কিছু পাচ্ছে না। বিরক্তিকর পরিস্থিতি। হঠাৎ
একজন পাশে এসে দাঁড়াল। বেশ লম্বা, সুপুরুষ।
হাতের ছাতাটা অনেকটা মৈত্রেয়ীর দিকে দিয়ে
অন্য দিকে তাকিয়ে আছে। মতলব কী এই
মানুষের? একটু ভয় ভয় করছে মৈত্রেয়ীর। একটু
সরে দাঁড়াবে বলে পা বাড়াতে যাচ্ছিল মৈত্রেয়ী।
'ভয়ের কিছু নেই আমিও গাড়ির অপেক্ষা করছি।
আপনি কোন দিকে যাবেন?'
'বেহালা' সংক্ষিপ্ত উত্তর মৈত্রেয়ীর।
'ও আমিও পর্ণশ্রী যাব।'
একটা অটোরিক্সা সামনে এসে দাঁড়াল। 'কোথায়
যাবেন আপনারা?'
'বেহালা'
'এই শোনো বেহালা পর্যন্ত রিজার্ভ করবো কত
দিতে হবে বলো?'
' চলুন  উঠে পড়ুন'
মৈত্রেয়ীর দোনোমোনো ভাব দেখে এক রকম জোর
করেই অটোতে তুলে নিল ভদ্রলোক।
সেই ছাতার তলা থেকে তাদের সম্পর্ক কী ভাবে
ছাদনাতলা পর্যন্ত গড়াল।  সব এখন স্মৃতি।
ততদিনে মৈত্রেয়ী কলেজে অধ্যাপনার চাকরি
পেয়েছে। অরিন্দম একটি বিখ্যাত এম এন সি'র
ইঞ্জিনিয়ার।
বেশ হাসি খুশির সংসার দুজনের। বছর দুইয়ের
মধ্যেই মৈত্রেয়ীর কোল উজ্জ্বল করে মিঠি এলো।
কত আনন্দ দুজনের।
মিঠির যখন চার বছর বয়েস, অরিন্দমের অফিস
থেকে তাকে আমেরিকায় পাঠানো হল। খুব মন
খারাপ তার। ছোটো মেয়েকে ছেড়ে যেতে মন
চাইছে না। তবুও যেতে হল। প্রায় প্রতিটি রাতে
ফোনে কথা হতো। দেখতে দেখতে ছয় মাস কেটে
গেল। এবার অরিন্দমের ফেরার পালা। মৈত্রেয়ীর
আনন্দ আর ধরে না।
অরিন্দম এলো। কথা হল। কিন্তু কোথাও যেন
খাপছাড়া ভাব অনুভব করছে মৈত্রেয়ী। প্রথম
কয়েকদিন ভাবলো এত জার্নি করেছে তাই
হয়তো। কিন্তু দিন এক এক করে চলে যায় তবুও
অরিন্দমকে খুঁজে পায় না মৈত্রেয়ী।
'কী হয়েছে তোমার? '
'কিছু না তো।'
'তুমি ঠিক করে কথা বলছ না, কাছে আসছ না?'
'এই তো, তোমার কাছেই আছি আর কী ভাবে
কাছে আসবো?'
মৈত্রেয়ী বুঝতে পারে, কোথাও একটা আনমনা
ভাব রয়েছে অরিন্দম এর মধ্যে।
মাস দুই পর এক রাতে খাবার পর অরিন্দম বলে,
'শোনো, আমাকে আবার বিদেশে যেতে হবে।'
'আবার? এবার কোথায়, কতদিনের জন্য?' এক
নিশ্বাসে কত প্রশ্ন করে গেল মৈত্রেয়ী।
'জানি না।'
তিনদিন পর অরিন্দম আবার বাড়ি থেকে বিদেশ
যাবার জন্য বেরোচ্ছে, কিন্তু এবার কোনো উতলা
ভাব নেই। মেয়েকে ছেড়ে যাবার দুঃখ চোখে পড়ছে
না। যাবার সময় শুধু কোলে তুলে চুমু খেয়েছিল
মিঠির কপালে।
'আসি। সাবধানে থেকো।'
তারপর ফোন করাও কমে গেল অরিন্দমের।
মৈত্রেয়ী ফোন করলেও তুলতো না।
আজ বাইশ বছর অরিন্দম মৈত্রেয়ীর মিউচ্যুয়াল
ডিভোর্স হয়ে গেছে। অরিন্দম ফিরে এসেছিল।
মৈত্রেয়ী না, তখন তার জীবনে অন্য নারী। ভেঙে
পড়লেও মৈত্রেয়ী কোনো বচসায় যায়নি। ওর
কথায় ডিভোর্সে রাজি হয়ে গিয়েছিল। এছাড়া তার
আর কী করার ছিল। এতগুলো বছর একা হাতে
মিঠিকে বড়ো করেছে। মা-মেয়ের যৌথ সংসার।
'এই নাও গরম- গরম চা, আর মুড়ি মাখা'।
চা খেতে খেতে মিঠি বলে উঠলো, 'মা আর কতদিন
এ ভাবে চলবে। তুমি কোথাও সেটেল হলে আমিও
আমার লাইফ ফুললি এনজয় করতে পারি। তুমি
আবার বিয়ে না কর, কিন্তু একটা বয়ফ্রেন্ড তো
থাকতেই পারে। আজকাল কত চ্যাটিং অ্যাপ
আছে। কত ডিসেন্ট পারসোনালিটির লোক আছে
এমন সব গ্রুপে । তারা ম্যাসেজ চ্যাট করে,
ভার্চুয়ালি কথা বলে। অনেক সময় এমন গ্রুপের
সবাই একসাথে দেখা করে, ঘুরতে যায়। তোমার
চিন্তা করে করে আমি বুড়িয়ে যেতে বসেছি।'
মৈত্রেয়ী মন দিয়ে মিঠির কথা শুনছিল। সময় কত
পালটে গেছে। কত সহজে এরা জীবনের ডিসিশন
নিয়ে নিতে পারে।
চা খাওয়া শেষ করে, মৈত্রেয়ী খালি কাপগুলো
তুলে নিয়ে ঘরের ভেতর যাবার সময় মিঠির মাথায়
হাত রেখে বলল, 'সে সবের দায়িত্ব তোর।'