ছোটো গল্প : দেবব্রত রায়


 





কস্তুরি গন্ধ


দেবব্রত রায় 


 আমি প্রায় আধঘন্টা ধরে আমার বউয়ের জন্য গাড়ির ভিতরে 
বসে আছি আর,আমার বউ মুক্তোমালা বসে আছে অন্য লোককে নিয়ে । 
মুক্তোমালার পাশে বুলন দাঁড়িয়ে আছে।সে মাঝেমাঝেই 
চোখ টিপে টিপে আমার দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসছে। 
আমার বউ আমার দিকে পিছন ফিরে বসে আছে। বুলন দাঁড়িয়ে 
আছে ওর ঠিক পাশটিতেই। আমি আশ মিটিয়ে বুলনকেই দেখছি ! 
দুধ-সাদা অ্যাপ্রোনে বুলনকে যেন লেকের জলে ভেসে বেড়ানো
 রাজহংসীর মতন লাগছে !  বুলন খুব সুন্দরী। খুবই সুন্দরী। 
যাকে বলে একেবারে ডানামেলা ফেরেশতার  চেয়েও  সুন্দরী !
 চাঁদের সঙ্গে ওর রূপের তুলনা করলে চাঁদের ষোলোকলাও 
যেন যাচ্ছেতাই ভাবে বুলনের ওই আশ্চর্য রকম 
রূপ-জৌলুসের কাছে হেরে যাবে ! 
          অফ-ডে থাকলেই, বুলন আমাদের কোয়ার্টারে এসে হাজির হয়।
 কোনো কোনো দিন হোস্টেলে খাওয়াদাওয়া সেরে এসে বিছানায় 
আমার আর,মালার মাঝখানে ধপাস করে শুয়ে পড়ে বলে ,
 "শালী আধি ঘরবালি ! " ওর শরীর থেকে একটা অদ্ভুত মিষ্টি গন্ধ 
এসে আমাকে ভীষণরকম নেশাতুর করে তোলে ! মৃগনাভির তীব্র গন্ধ
 যেমন সমস্ত জঙগল জুড়ে  ম-ম করে ঠিক তেমনিই আমাদের 
কোয়ার্টারের বাতাসও যেন শুধু, আমাদেরকে ঘিরেই জমাট বেঁধে ওঠে ! 
 কস্তুরি-মৃগের মতো বুলন চব্বিশঘন্টায় আমাকে নেশাতুর করে 
রাখে কিন্তু, সেই ঘ্রাণ বোধহয়, মুক্তোমালার নাকে পৌঁছায় না ! 
নিজেকে একজন চোরা-শিকারী ভাবতে আমার নিজেরই 
কেমন যেন অপরাধী অপরাধী ঠেকে  ! অনেক ভেবেও কিছুতেই 
বুঝতে পারিনা, একটা গন্ধ মানুষের শরীরে,মনে কী-এমন 
কেমিক্যাল রিয়্যাকশন তৈরি করে যার জন্য অলঙ্ঘনীয়  
সবকিছুই একেবারে ভেঙে চুরমার করে দেবার এরকম 
একটা খারাপ ইচ্ছে মাথার ভিতরে জন্ম নেয় ! 
  মুক্তোমালা আমাকে ভীষণ ভালোবাসে বোধহয়, নিজের 
থেকেও বেশি-ই ভালোবাসে ! এতদিন আমিও  জানতাম, 
মুক্তোমালাবিহীন আমি একেবারেই অন্ধ এমনকী, সূর্য, 
গ্রহ,চাঁদ সহ সবকিছুই যেন আমার কাছে হিমাচলপ্রদেশের 
অট টানেলের মতোই  অন্ধকার আর,আমি সেই বিপজ্জনক 
অন্ধকারের ভিতরে একটি বিগ জিরো কিন্তু,  বুলন এই হাসপাতালে 
জয়েন করার পর থেকেই, গত একবছর ধরে আমার সবকিছুই কেমন 
যেন উলোটপালোট হয়ে যাচ্ছে ! নীৎসে,সেপেনহাওয়ার,  ফ্রয়েড পড়েও 
কিছুতেই যেন এসবের কোনো কুলকিনারাই খুঁজে পাচ্ছিনা ! 
         
             আমি গাড়ির থেকে নেমে ইমার্জেন্সি রুমের ভিতরে উঁকি মারতেই 
দেখলাম একটা টুলের উপরে নীরজ মাদ্রাজি  দুচোখ ভর্তি জল নিয়ে 
পাংশু মুখে বসে আছে । মুক্তোমালা-র হাতে ওষুধভর্তি একখানা 
বড়ো সিরিঞ্জ। নীরজ হাসপাতালে লাশ ফাড়াই করে।  
আমাকে দেখেই সে একেবারে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। 
বললো, জামাইবাবু, হামাকে বাসান ! ডাগদার-দিদি হামাকে মারিয়ে ফেলসে ! 
মুক্তোমালা ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জখানা শক্ত করে ধরে বসে 
আছে এবং আমাকে শুনিয়েই বোধহয়, সে বেশ কঠিন গলাতে 
নীরজকে বললো, আজ আমার হাত থেকে কেউ তোমাকে বাঁচাতে পারবে না !  
আমি চোখের ইশারায় বুলনের কাছে ব্যাপারটা জানতে চাইলাম 
কিন্তু, দেখলাম, বুলন এখন ভীষণরকম গম্ভীর থাকার গুরুত্বপূর্ণ
 ডিউটিতে ব্যস্ত !  ও জানে মুক্তোমালা ডিউটির সময় হাসি-ঠাট্টা একেবারেই 
পছন্দ করেনা ! বুলনও ওর দিদির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নীরজকে ধমকাতে 
ধমকাতেই যে টুকু বললো, তাতেই বুঝলাম, নীরজ আজ নেশা করে 
ইন্ডোরে ঢোকার জন্য গেটকিপার রঘুনন্দনের সঙ্গে প্রথমে ঝগড়া 
শুরু করেছিল তারপর , সেই ঝগড়া নাকি, একেবারেই হাতাহাতির 
পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল ! 
মুক্তোমালা ভীষণ গম্ভীর গলাতেই বললো, নেশা-র গন্ধ তোমার কাছে 
কস্তুরী-গন্ধ মনে হতেই পারে কিন্তু, পেসেন্ট এবং আমাদের কাছে 
সেটা একেবারেই অসহ্য তাই, তোমার ঐ বদ নেশা ছাড়ানোর জন্য 
এই ইঞ্জেকশন দেওয়া ছাড়া আমার হাতে আর অন্য কোনো অপশন  নেই ! 
এই বলে মুক্তোমালা নীরজের চোখের সামনেই ওর হাতে ধরা 
সেই ভয়ংকর সিরিঞ্জটার থেকে  ওষুধের মতোই সামান্য কী একটু বের 
করে তুলো দিয়ে নিডলটা মুছে সেটা যেন আরও ঝকঝকে করে তুললো ! 
আমি মুক্তোমালার মুখে হটাৎ-ই,কস্তুরি-গন্ধ কথাটা শুনেই চমকে 
উঠে বুলনের দিকে তাকালাম। মুক্তোমালা কি তাহলে, আমার আর,
বুলনের গোপন গন্ধের খেলাটা ধরে ফেলেছে ! দেখলাম, বুলনের মধ্যে 
কোনো ভাবান্তরই নেই, সে নিস্পৃহ মুখে মুক্তোমালা-র নির্দেশ পালন করছে । 
আমি পরিবেশটাকে সামান্য হালকা করার জন্য হেসেই বললাম,
" ইঞ্জেকশন নিতে এত ভয় পাওয়ার কী আছে ,ওরা তো আমার মুখে 
হেমলক তুলে দিলেও আমি প্রেমসে খেয়ে নিতুম  ! " কথাটা যেন একটু বেশি-ই 
বেফাঁস হয়ে গেল ভেবে আমি মনে মনে প্রমাদ গুনলাম ! 
নীরজ ওর চোখের জল,নাকের জল মুছতে মুছতে বললো,
 সে হামি ভি হামলোক খাইয়ে লিব লেকিন, এই দারু ছোড়ানোর 
সুঁই লাগালে হামি মরিয়ে যাব জামাইবাবু কিঁউকি , 
ও তো হামার জান আছে না ! 
                               নীরজের কথা শুনে আমি   আবারও ভীষণরকম 
চমকে উঠলাম আর,সঙ্গে সঙ্গেই খেয়াল  করলাম,ওষুধপত্রের তীব্র 
গন্ধটা হটাৎ-ই, যেন হাওয়ার মধ্যে মিলিয়ে গেল ! তার বদলে ইমার্জেন্সিরুমের 
ভিতরে একটা কস্তুরি-গন্ধ ধীরে ধীরে  চাপ বেঁধে উঠতে লাগলো আর, 
সমস্ত হসপিটাল-কম্পাউন্ডটাই যেন দিনেদুপুরে ভোজবাজির মতো 
একটা গভীর জঙগলে রূপান্তরিত হয়ে গেল ! সেই গভীর জঙগলের
 ভিতরে একটা মিষ্টি গন্ধের উৎস লক্ষ্য করেই আমি চোরা শিকারীর 
মতো পা টিপে টিপে এগোচ্ছিলাম নাকী,সেই তীব্র গন্ধটাই আমাকে  
টেনে নিয়ে যাচ্ছিল সেটা আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না ! 
 মেস্মেরাইজডের মতো এগোতে-এগোতেই আমি লক্ষ্য করলাম,
একটা বিশাল বড়ো সিরিঞ্জ হাতে নিয়ে মুক্তোমালাও আমার পিছনে 
পিছনে প্রায় দৌড়োতে দৌড়োতেই আসছে !  ও একেকবার আমার 
খুবই কাছাকাছি চলে আসছিল কিন্তু, শেষপর্যন্ত মুক্তোমালা আমাকে 
যেন কিছুতেই ধরতে পারছিলনা !