ধারাবাহিক : সন্দীপন গোস্বামী

 





স্বদেশী বিজ্ঞাপনের জনক

সন্দীপন গোস্বামী

 

শিল্পী রণেন আয়ন দত্তকে নিয়ে ইতিমধ্যেই আলোচনা হয়েছে। 

বলা হয়নি, তাঁকে চারুকলার ঘেরাটোপ থেকে বিজ্ঞাপনের 

জগতে নিয়ে আসেন অন্নদা মুন্সী। বিস্মৃত তিনিও। অথচ বিদেশি 

কাজ হুবহু টুকে দেওয়ার রাস্তা থেকে সরে এসে তিনিই 
এ দেশে একেবারে নিজস্ব স্টাইলে বিজ্ঞাপনের ছবি আঁকতে 
শুরু করেন। যাকে পুরোপুরি দেশীয় স্টাইলও বলা যায়। 
এ’ব্যাপারে সম্ভবত তিনিই পথিকৃৎ। সত্যজিত রায়ও 
বিজ্ঞাপনী সংস্থায় অন্নদার অধীনে কাজ করেছেন। এই শিল্পীর 
আর একটা পরিচয়, গানবাজনাতেও তিনি অসম্ভব দক্ষ ছিলেন। 
মজার ব্যাপার, আর এক শিল্পী রঘুনাথ গোস্বামীর সঙ্গে 
অন্নদার হৃদ্যতা হয়েছিল এই সঙ্গীতের সূত্রেই। তিনিই 
রঘুনাথকে দিয়েছিলেন ইউরোপীয় সঙ্গীত শোনার পাঠ। 
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর একটা জার্মান বেহালা 
অন্নদা মুন্সীর কাছে ছিল। তা তিনি দিয়ে দেন রঘুনাথকে। 
পিয়ানো, হারমোনিয়াম বা বেহালায় তাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীত 
বাজানো শুনে অনেকেই মুগ্ধ হয়ে যেতেন। এমনিতে 
অনেকেই শ্রী মুন্সীকে এ দেশের বিজ্ঞাপনী অলঙ্করণের জনক 
মনে করেন। সত্যজিতও নাকি তাঁর কাছ থেকে 
ক্যালিগ্রাফি শিখেছিলেন। অনেকে তো এও বলেন, ইলাস্ট্রেটর 
সত্যজিতকে তিনিই আবিষ্কার করে পাদপ্রদীপে এনেছিলেন। 
এই শিল্পীর জন্ম ১৯০৫ সালে। ও পার বাংলার পাবনায়। 
ছোটবেলা থেকেই গানবাজনা আর ছবি আঁকায় আগ্রহ ছিল 
মারাত্মক। কিশোর অন্নদা কত কীই না করেছেন। এমনকি পুতুল 
তৈরি বা ঝিনুকে অঙ্গসজ্জার কাজও। এ হেন আগ্রহের জন্যই 
তাঁকে পরবর্তীকালে দেখা গেল আর্ট কলেজের একজন কৃতী ছাত্র 
হয়ে উঠতে। প্রথম চাকরিটা করলেন এই শহরের আর্মি অ্যান্ড 
লেভি স্টোর্সে। সেখানে তিনি ছিলেন শো-কার্ড লেখক 
ও শো-কেস শিল্পী। সেখান থেকে কখনও তিনি মুম্বইয়ের 
টাইমস অফ ইন্ডিয়ার বিজ্ঞাপন দফতরে। কখনও বা বিখ্যাত 
অ্যাড এজেন্সি ডি.জে কিমারে আর্টডিরেক্টর। রেলওয়ে আর 
টি-বোর্ডের বিজ্ঞাপনে শ্রীচৈতন্য, বুদ্ধ, বিবেকানন্দের মতো 
ভারতীয় মহাপুরষদের সংশ্লিষ্ট করা সেইসব কাজ কোনও 
দিন উপেক্ষা করা যাবে না। কিন্তু এখনকার প্রজন্ম সে সবের 
কিছুই প্রায় জানে না। সেই সব কাজ সুন্দর করে সংগ্রহ করে, 
শুধু পুরনো বিজ্ঞাপনগুলির সংকলন করেই চমৎকার 
একটা বই হতে পারে। এ দেশে নতুন প্রজন্মের গবেষণায় 
আগ্রহ নেই এমন তো নয়। ভাল হত, রাষ্ট্র যদি এই ধরনের 
উদ্যোগের পৃষ্ঠপোষকতা করতে এগিয়ে আসত। কিন্তু সে 
আর এ দেশে হচ্ছে কই! পশ্চিমী নারীপুরুষের সাহেবিয়ানা 
সর্বস্ব সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণ বন্ধ করে আন্নদা মুন্সী যে 
আটপৌরে চরিত্র বিজ্ঞাপনে একসময় এনেছিলে, তা ক’জন আর 
জানতে পারছে। অথচ কী আসাধারণ সে সব কাজ। অসম্ভব 
আধুনিক সব লে-আউট। চায়ের বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্রনাথের 
কবিতা আনা, বা নিজর স্ত্রীর ফটোগ্রাফ দিয়ে বিজ্ঞাপন করার 
মতো নানারকম আইডিয়া সেই সময়ের নিরিখে সত্যিই 
ছিল অভিনব। ১৯৪৭ সালে করা তাঁর একটা বিখ্যাত 
বিজ্ঞাপনের কথা প্রসঙ্গত মনে পড়ছে। বাড়ির দুয়ারে 
চরকার সামনে বসে আছেন শাড়ি পরা এক বঙ্গরমনী। 
তাঁর হাতে চায়ের কাপ। তলায় ইংরেজিতে লেখা, 
‘চা-শতকরা একশো ভাগ স্বদেশী’। সে কাজকে অনবদ্য 
বললেও যেন কিছু বলা হয় না।

এই শিল্পীর প্রয়াণ ১৯৮৫তে।