অগ্রহায়ণ সংখ্যা-প্রশ্নোত্তরে দীপক কর : শুভদীপ সেনশর্মা

মঙ্গলবার, ১৭ নভেম্বর, ২০২০ /
ফেসবুক-এ শেয়ার করুন /
টুইটার-এ শেয়ার করুন

 | ১৪০০ সাল পত্রিকা

প্রশ্নোত্তরে দীপক কর : শুভদীপ সেনশর্মা









শুভদীপ : দীপকদা, আপনি পাঁচের দশক থেকে লেখালেখি শুরু করেছেন। দীর্ঘ সাত দশক পেরিয়ে এসে কি আপনার মনে হয়, বাংলা কবিতার বাঁক বদল ঘটেছে? নতুন কন্টেন্টের আবির্ভাব ঘটেছে? নাকি পুরোনো কন্টেন্টকে রিমডিফাই করা হচ্ছে?

দীপক কর : পাঁচের দশকে লেখালেখি মানে স্কুল ম্যাগাজিনে উঁচু ক্লাসে একটু আধটু। তা'র বাইরে কোথাও নয়। খুব ছোট্ট বয়েসে মাতৃবিয়োগ, পঞ্চাশের মার্চমাসে দাঙ্গার পর ক্লাস সিক্স-এ পড়তে পড়তে বাবার অশ্রুসিক্ত ছবি বুকে নিয়ে এপারে খড়্গপুরে মামাদের আশ্রয়ে পড়াশোনার তাড়নায়। এসব বেদনাবোধ একটা মেঘলা আকাশ তৈরি করেছিলো। তা'র-ই ঝরন পরবর্তী জীবনে পত্র-পত্রিকায় ছয়ের দশকের শেষ দিকে। 'বাংলা কবিতার ধারাবদল', 'নতুন কন্টেন্টের আবির্ভাব' প্রসঙ্গে গ্রিক দার্শনিক Heraclitus উঁকি দ্যায় :
'into the same river no man can enter twice.' একই নদীতে দু'বার অবগাহন না করলেও ফল্গুধারাটা অস্বীকার করবে কে? যে দেহটা নিয়ে আমি আজ সে কি অতীত দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন?
কাব্য প্রবাহের বহিরাবরণে রং বদল হয়। কিন্তু প্রবাহটা থেকেই যায়। সে প্রবাহের আসল নাম কবিতা। কন্টেন্ট একই। বাকিরা আসে যায়। শুধু নতুন বোতলে পুরোনো মদিরা।

শুভদীপ : কবিতায় শব্দসৃষ্টিই কি কবির একমাত্র কাজ? এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?

দীপক কর : কবিতায় শব্দসৃষ্টি এক শিল্পকর্ম। প্রয়োগ সঠিক না-হলে কুৎসিত। শব্দের তুলিতে যে লাবণ্যের বিভাস কবিতা তো তা'র-ই নাম।

শুভদীপ : আপনার সৃষ্টিগুলির নামের দিকে নজর দিলে বোঝা যায় আপনার ভেতর এক অদ্ভুত বিষণ্ণতা ও কর্তব্যবোধের সঞ্চার ঘটে। অথচ কবিতার মধ্যে অনন্ত দর্শনবোধ, নির্ভার ও সাবলীলতা দেখতে পাই।এরকম পরিবর্তনের কারণ যদি জিজ্ঞেস করি...আপনি কী বলবেন?

দীপক কর : আমার কবিতায় অশ্রুঝরনে : 'Thinking of the days that are no more.'
অশ্রুবরণে : 'Our sweetest songs are those that tell of saddest thought.'

শুভদীপ : ধানসিড়ির কথা শুনতে চাই। কীভাবে শুরু হল সম্পাদক দীপক করের যাত্রা। আর কেনই বা পত্রিকাটির প্রকাশ থামিয়ে দিলেন। পত্রিকাটি নিয়ে আগামীতে কোনো পরিকল্পনা আছে কি?

দীপক কর : সাতের দশকের প্রথম দিকে খড়্গপুরে 'প্রতীক' নামে এক ত্রৈমাসিক সাহিত্য-পত্রিকায় নিয়মিত কবিতার আঁচড়কাটা। অন্তরে তখন কাব্যজোয়ার। কিন্তু তিন মাসের অপেক্ষা। মন মানে না। সিদ্ধান্ত নিলাম এক দ্বিমাসিক-এর। সম্পূর্ণ কাব্যরেখার। 'প্রতীক'-কে বিব্রত না করে। সাহিত্যিক বন্ধুদের আমন্ত্রণ জানালাম। এলেন আমার মেসঘরে 'প্রতীক'-এর শ্রদ্ধেয় সম্পাদক অধ্যাপক সমীরেশ দাশগুপ্ত, কবি কালীপদ কোঙার, সুহৃদ কবি ও গল্পকার শ্যামাপ্রসাদ ভট্টাচার্য। আমার অন্তরের বাসনা জানালাম। নাম নির্বাচন করলাম আমার অন্তরের কবির উচ্চারণ : ধানসিড়ি। মেনে নিলেন সবাই। কালীপদবাবু যেহেতু বয়োজ্যেষ্ঠ, সম্পাদক হিসেবে তাঁর-ই নাম উপস্থাপন করলাম। সহযোগী সম্পাদকের দায়িত্বে শ্যামাপ্রসাদ ভট্টাচার্য ও আমি। আর্থিক দায়িত্বের ভার আমার-ই কাঁধে প্রায় সম্পূর্ণ। সে-সংখ্যায় আমার কিঞ্চিৎ ভূমিকাসহ জীবনানন্দের চিঠি। তা'তে-ই নিবিড় সাড়া। আর্থিক দায়-দায়িত্বের সঙ্গে লেখা সংগ্রহের দৌড়-ঝাঁপ। আমার অক্লান্ত পথচলা। একদিন খড়্গপুর থেকে সংসার-প্রয়োজনে মেদিনীপুর চলে আসা। সঙ্গে
ধানসিড়ি। তৃতীয় বর্ষ ১৯৭৫ থেকে পঁয়ত্রিশ বর্ষ ২০০৭ শারদসংকলনে আমার একক সম্পাদনায় ধানসিড়ি-র শেষ নিঃশ্বাস। অর্থের দিকটি ভাবিনি কখনো। কিন্তু শেষ বয়েসে একা পত্রিকার জন্য দৌড়-ঝাঁপ পারছিলাম না আর। বন্ধ করে দিতে হলো ধানসিড়ি-র প্রবাহ। সবাই অনুপ্রেরণার সুর বেঁধেছিলেন অন্তর থেকে। বিশেষ করে নবনীতাদি। কিন্তু 'Hand and brain do not walk hand in hand' সবাই বোঝেন। কেউ যদি ধানসিড়ি থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ, কবিতা প্রকাশের উদ্যোগ নেন, সাধুবাদ জানাবো।

শুভদীপ : দীপকদা, শেষ প্রশ্ন, আপনি ছায়াছবির শ্যুটিং ইউনিটের সঙ্গে কাটিয়েছিলেন বেশ কয়েকদিন। কখনও মনে হয়নি সাহিত্য ও সিনেমা একে অপরের পরিপূরক হতে পারে?

দীপক কর : আমার কলেজ কোয়াটার্সে পূর্ণেন্দু পত্রী-র পরিচালনায় 'ছোট বকুলপুরের যাত্রী'-র শ্যুটিংপর্বে আমার ঘরে পূর্ণেন্দুদা-র প্ৰাণোজ্জ্বল অবস্থান। কত কথা, গান, আড্ডার জোয়ার।
              সাহিত্য থেকে সিনেমা যাত্রা এটাই তো রীতি। তবে সিনেমা প্রভাবিত হয়ে কেউ কেউ গদ্যে-পদ্যে হাত দিতেই পারেন।