সম্পাদকীয় : চন্দ্রদীপা সেনশর্মা

শুক্রবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০২১ /
ফেসবুক-এ শেয়ার করুন /
টুইটার-এ শেয়ার করুন

 






সম্পাদকীয়  : চন্দ্রদীপা সেনশর্মা 

আমার বাবা অজয় দাশগুপ্ত এই পত্রিকার
প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন। পত্রিকাটির এই
সংখ্যা স্মরণবেদনায় তাঁকে উৎসর্গ করলাম।
গল্পলেখক ঔপন্যাসিক কবি অনুবাদক সম্পাদক
সমালোচক অজয় দাশগুপ্ত, যিনি একটি গ্রন্থও
রেখে যাননি প্রমাণ-স্বরূপ, তাঁর এই সর্বত্যাগী
উদাসীন মানসিকতা ব্যাখ্যা করার মতো যোগ্যতা
আমার নেই।

পাঁচের দশকে বিমল করের সঙ্গে 'ছোটগল্প নতুন
রীতি' বাবার একটি অসামান্য কাজ। ছোটগল্পে'র
শুরু, শেষ, প্যারাগ্রাফ অ্যারেঞ্জমেন্ট হাতে ধরে
অনেককেই শিখিয়েছেন। উদ্বাস্তু অজয়ের সামান্য
ভাড়ার বাসায় বহু লেখকের লেখা ফাইলবন্দি 
থাকত, এ সব কাজের কোনো স্বীকৃতি তিনি পেতে
চাননি। খুব অল্পবয়স থেকে লেখালেখি শুরু
করলেও তিনি সাহিত্য আঁকড়ে পড়ে থাকেননি।
সংগীত খেলাধুলো সবে তাঁর সমান আগ্রহ ছিল।
তিনবছর বয়সে কাঁচাঘুম ভেঙে জেগে উঠতাম
ক্রিকেট কমেন্ট্রি শুনতে, তখনো রাত। দেশলাই
বাক্স জড়ো হতো নিত্যনতুন, উপরে একজন
ক্রিকেটারের ছবি। এভাবে আমার ক্রিকেটার
চেনার পালা। একটু বড়ো হয়ে বাবাকে জিজ্ঞেস
করেছিলাম তুমি কোন কোন খেলার নিয়ম জানো
না। একটু ভেবে বলেছিলেন রাগবি পোলো গলফ
বেসবল। জীবনসায়াহ্নে তিনি অনেকাংশে গলফ
জেনে নিয়েছিলেন।

বাবার একটি রেকর্ডপ্লেয়ার ছিল, আর ছিল ধ্রুপদি
সংগীতের অনবদ্য সংগ্ৰহ অসংখ্য রেকর্ডে। আমার
ছোটবেলা কখনো বিষ্ণু দিগম্বর পলুস্কর গাঙ্গু বাঈ
হাঙ্গল ফৈঁয়াজ খাঁ বেগম আখতার এঁদের গান
শুনে কেটেছে, কখনো রবিশঙ্কর আলী আকবর
বিলায়েত বিসমিল্লাহ্ আহমেদজান থিরাকোয়া
কেরামতুল্লাহ্ আল্লারাখা শোনার সৌভাগ্যে
কেটেছে। ইহুদি মেনুহিন বিটোফেন বাখ্ মোৎসার্ট
জুবিন মেহতা বাবার সংগীত প্রেম আমাকেও
আচ্ছন্ন করেছিল, আজও করে। তিনি কূপমণ্ডূক
ছিলেন না। ক্লিফ রিচার্ডস পিট সিগার ফ্রাঙ্ক
সিনাত্রা বিটলস বব ডিলান মন দিয়ে শুনতেন।
ভারতীয় বীণা সেতার সরোদ সানাই...পশ্চিমী
চেলো পিয়ানো স্যাক্সোফোন গিটার তাঁর অত্যন্ত
প্রিয় ছিল। ভি বালসারা বাবার খুব কাছের বন্ধু
ছিলেন। যে কোনো নৃত্যেও বাবার আগ্রহ ছিল
অপরিসীম। ভারতীয় ধ্রুপদি নৃত্য, পশ্চিমী ধ্রুপদি 
নৃত্য, দেশ বিদেশের বিভিন্ন লোকনৃত্য তিনি উদার
মনে সব গ্রহণ করতে পারতেন।

নানাবিধ কারণে এবং অর্থনৈতিক প্রতিকূলতায়
তিনি লেখা প্রায় ছেড়ে দিলেন। জিজ্ঞেস করলে
বলতেন, আমার প্রিয় ফুটবলার চুনী গোস্বামী, টপ
ফর্মে অবসর নিতে পেরেছেন। সময়মতো অবসর
নিতে আমরা শিখি না। সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত অন্য
কাজ করে অতি কষ্টে তিনি জীবন কাটিয়েছেন।
তবু তাঁর মুখের হাসিটি ছিল অমলিন। তিনি
বাচ্চাদের সঙ্গে মজার গল্প করতে পারতেন, সহজে
তাদের প্রিয় মানুষ হয়ে উঠতেন। গল্পে গল্পে তিনি
মানবিক হতে শেখাতেন। ছোটবেলায় ঘরে ফড়িং
প্রজাপতি ঢুকে পড়ত। হয়তো ঘরে থেকে গেল
এবং মৃত্যু হল, বাবা বলতেন, যাও মাটি চাপা দিয়ে
এসো।

শেষ বয়সে আপনখেয়ালে তিনি বেশ কয়েকটি
চতুর্দশপদী লেখেন। এই কবিতাগুলি নিয়ে একটি
ছোট গ্রন্থ, 'শেষ প্রস্তাবনা' প্রকাশিত হয় কবিতা
পাক্ষিক থেকে। এই বইটি এবং কালিদাসের
মেঘদূতম্ এর অনুবাদ, এই দুই বই নিয়ে কাব্য
সংগ্ৰহ অজয় দাশগুপ্ত ২০১৯ সালে কমলিনী
থেকে প্রকাশিত হয়। তাঁর একটি গল্প সংকলন
প্রকাশ এবং উপন্যাস খুঁজে পাওয়ার প্রয়াস
আমাদের করে যেতে হবে। সাহিত্যে তাঁর
অনুধ্যানের পরিসরটিও খুব বড়ো ছিল। অনন্য
স্মৃতির অধিকারী হওয়ায় এক দুবার পড়লেই তিনি
মনে রাখতে পারতেন। না দেখে তিনি দীর্ঘকবিতা
একের পর এক আবৃত্তি করে যেতেন।

"হয়তো তিনি চেয়েছিলেন একটি শৈল্পিক
আবরণ--এমন একটি সংহত কাব্যরূপ যা
চতুর্দশপদীতে পাওয়া সম্ভব।........স্মৃতি, প্রেম,
সংগীত আর মর্মাহতের কালচেতনা তাঁর এই
কবিতাগুলির বিষয়। তিনি লেখেন:
'সার সার দীপমালা, শিয়রে তোমার
উজ্জ্বল চাঁদের আলো, রাত্রিচরাচর।
অবিরাম ছুঁয়ে যাও বালির পাহাড়
ক্লান্তিহীন খেলা এই। শব্দের ভিতর
সম্মোহ ছড়িয়ে দাও, মুগ্ধ হয়ে দেখি।
উপরে অনন্ত নভে দূর তারকারা
নিভৃতে রয়েছে জেগে--যেন বা জোনাকি।
জলের নিজস্ব গন্ধ--আমি আত্মহারা।'

কয়েকটি আশ্চর্য পঙ্ ক্তি পড়া যাক:
'কল্যাণপ্রদীপ হাতে মঙ্গলবারতা
নিয়ে চল জীবনের শীত গ্রীষ্ম রাতে।
বসন্তের বিনোদন, অবিনশ্বরতা
তোমাকে আবৃত করে শ্রাবণধারাতে।'"
---পূর্বলেখ কাব্য সংগ্ৰহ, কালীকৃষ্ণ গুহ

মেঘদূতমের দুটি অনুবাদ পড়া যাক:

৪. পূর্বমেঘ
অন্তর জর্জর কেমনে কাটে তার সঙ্গীহীন ঘরে
মেদুর দিন/ তোমাকেই জলধর যদি না দূত করে
পাঠাই তাকে আমি সুসংবাদ।/ সকুটজ পুষ্পের
অর্ঘ্য হাতে নিয়ে যক্ষ এই ভেবে প্রীতির গান,/
সুগভীর কন্ঠের স্বাগত সম্ভাষ শোনায় মেঘবরে
মধুরতায়।

২৩. উত্তরমেঘ
আমি দূর একা সেই প্রেয়সী পড়ে আছে শঙ্কা বুকে
নিয়ে মৃতের প্রায়,/ জানবেই জলধর দ্বিতীয় প্রাণ
মোর স্বল্পবাক হয়ে কাটায় দিন--/ যে রকম পদ্মের
হয় গো ম্লানরূপ শিশির সম্পাতে, তেমনি ঠিক/
সাথীহীন পাখিনীর মতই কাটে তার বিরহ ভরা
কাল দীর্ঘদিন।

বাবা ঈশ্বরবিশ্বাসী ছিলেন না। কিন্তু যে কোনো
ধর্মীয় অনুষ্ঠানে কেউ ডাকলে যেতেন, প্রসাদ
খেতেন, যদিও হাত কপালে ছোঁয়াতেন না। তিনি
কোনো বিষয়েই নিজের মত অন্যের উপর জোর
করে চাপাতেন না। দীর্ঘ চল্লিশবছর তাঁর সঙ্গে
কাটিয়ে বুঝেছি তিনি ছিলেন প্রকৃত নির্বাণপ্রাপ্ত
মানুষ। তাঁকে বলা হতো কলেজস্ট্রিটের ঝাঁকামুটে।
বাংলা সাহিত্যের বহু লেখক প্রকাশক তাঁর
কাঁধে চেপে পার হয়ে গেলেন, তিনি ক্রুশকাঠের
মতো সে ভার সানন্দে বহন করে গেলেন।