পুস্তক আলোচনা : ঋদ্ধি ঘোষ

শুক্রবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০২১ /
ফেসবুক-এ শেয়ার করুন /
টুইটার-এ শেয়ার করুন

 





পৃ-১.[  "জি, জন্মান্তরীণ...."]
 ক্যালিগ্রাফি <আকা/১২

স্মৃতি সাম্পান // 

ঋদ্ধি ঘোষ              [ পৃ--১]
 
 " মাথায় উড়ছে উন্মাদ-পঙক্তিরা..."
    """"""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""
সারাদিনের ব্যস্ততার তুঙ্গ থেকে নেমেও, বসতে ইচ্ছে করে প্রিয় পুস্তকের কাছে। মনে হয় সরাসরি
চলে যাই। দু দন্ড বসি। কবি চন্দ্রনাথ শেঠ-এর :
"জি, জন্মান্তরীণ এই আলপথে"  তেমনই একটি বই। পাঠক হিসাবে এ বই পাঠ আবেশ থেকে মুক্তি
 দেয় না মোটেও। টানা পক্ষকাল পড়ার পরও-- থেকে যায়--এক আনন্দঘন অভিজ্ঞতা। নিজেকে ছিন্ন করে নিতে পারি কই , আমি ?  সুগভীর এক তন্ময়তায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি :

.              মাথায় উড়ছে উন্মাদ পঙক্তিরা 
.              সন্ধ্যাতারাটি হেমলক বিষ হাতে...
.              'কাছে আয়!'--কাছে যাই
.              অমাবস্যার দিগন্ত সাঁতরাতে 

নূতন , মরমী, নিজস্ব  এক কাব্যভাষায়--চন্দ্রনাথ মেলে ধরেছেন তাঁর কবিতার ডানা।

*মাত্র দেড় ফর্মার বই ; প্রকাশক--বহুদিনের ঐতিহ্যবাহী 'তাঁতঘর' পত্রিকা। বইমেলা-২০২০. 
 প্রচ্ছদের দৃষ্টিনন্দন  ক্যালিগ্রাফিটি করেছেন--
নবীন-কবি সম্পাদক শুভদীপ সেনশর্মা। 

  *গভীর তন্ময়তায় গ্রন্থিত হয়ে পড়ি বইটির সাথে।পড়ে যাই , ঘোরলাগা সেইসব পঙক্তি :

ক>  এইতো লিখছি--
.    রাত্রি লাগা ঢেউ...
.            বেঘোরে মরে যাওয়া বিধ্বস্ত নদী
.                               ফ্ল্যাটবাড়ি প্রিয়-খেলামাঠ...
.                                                     ('কবিজন্ম')
খ> সারারাত ভরা বালতির মধ্যে ডুবে থাকা মগ

.             তার তো ডোবার কোনো সাগর নেই 
                                                     (মগ-জীবন)
গ> দোতারাজীবন ছিল ঘরে ঘরে বেজে উঠতিস 
      ছিল মুদ্রণপ্রমাদে ভরা মাথার আকাশ...
                                                      (প্রত্নলেখ)
ঘ> ইঞ্চিকয় সেলাই-জীবন...

ভাই-বোনে মিলে কলিচুনে রাঙিয়েছ কালো
রাত্রি-দেয়াল...এসো শব্দ নিশিভোর
জি, জন্মান্তরীন..../(পৃ--২.)
 

১   ২           ২    ১  |    ২        ২        ২  |  ১   ১= ৬+৬+২
u  ---        ---  u  |   ---    ---    ---   |u   u
মা থায়্    উড়্ ছে |   উন্     মাদ্    পঙ্   তি রা
২       ১  ১     ১    ১  | ২      ২        ২        ১  ১
---     u  u     u    u | ---    ---   ----   u    u   
সন্    ধা  তা  রা  টি  | হেম্ লক্ বিষ্   হা  তে 
১   ১   ২            ১    ১      ২
u    u   ---        u   u     ---
কা ছে আয়্ ---কা ছে | যাই্
১  ১     ২      ২    |   ১   ২    ১    ২   |     ১   ১
u  u   ---    ---      u  ---  u  ----   |  u   u
অ মা বস্ স্যার্ |   দি  গন্ ত  সাঁত্ |   রা তে

* এখানে সমস্ত রুদ্ধ (আদি, মধ্য, অন্ত)-দল দু'মাত্রার হয়েছে। এই হিসেবে সমান্তরালস্থ  পর্বগুলোর মাত্রার হিসাব :

চরণ--
১---> প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বে : ৬ মাত্রা, তৃতীয় বা প্রান্তিক পর্বে : ২ মাত্রা। 
২---> প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বে  : ৬ মাত্রা, তৃতীয়  বা
প্রান্তিক পর্বে : ২ মাত্রা।
৩---> প্রথম পর্বে : ৬ মাত্রা, দ্বিতীয়, তৃতীয় : 
২ মাত্রা। 
৪---> প্রথম পর্বে : ৬ মাত্রা, দ্বিতীয়, তৃতীয় :
২ মাত্রা। 
এর ফলে সমান্তরাল পর্বগুলোর পর্বসমতা দক্ষতার সঙ্গে রক্ষা করেছেন কবি।
বিন্যাস ঘটিয়েছেন : ৬ | ৬ | ২
.                              ৬ | ৬ | ২
.                                 ৬ | ২
.                               ৬ | ৬ | ২
রীতি : কলাবৃত্ত ( মাত্রাবৃত্ত )। লয় : বিলম্বিত না 
বলে ধীর বলাই শ্রেয়।
*এবার তাঁর কবিতার ক্রম অতিক্রমী চেহারার কথা বলা যাক।পূর্বজ দুটি কাব্য('ঝরনা কলম' এবং 'কাঠবাদামের মালা')-বৃত্তের বাইরে আসতে 
পেরেছেন তিনি? এর উত্তর আপাতদৃষ্টিতে দেওয়া 
কঠিন। তবু দেখা যাক। প্রথমেই তাঁর বিষয় বৈভবের কথা বলি :
অমারাত্রি, কবিজন্ম,  মগ জীবন, ছট-২০১৮, ২০১৯,  জি, এই আলপথ জেগে,  পে টয়লেট, লাঞ্চ ব্রেক, পাল উড়াইয়া দে--কবিতাগুলি সম সাময়িক ইতিহাসের দলিল। পড়ুন :

* // এইতো লিখছি :
. রাত্রি লাগা ঢেউ...
.   বেঘোরে মরে যাওয়া বিধ্বস্ত নদী
.   ফ্ল্যাটবাড়ি প্রিয়-খেলামাঠ...//
.     (কবিজন্ম) 

কৈশোরের-রম্য স্থানগুলি আজ--রক্তাত্ব, বিধ্বস্ত অথবা পুরোপুরি বিলুপ্ত। সেকথা লিখতে কবি যেন বদ্ধপরিকর। শুধু এই জন্যই তাঁর কবিজন্ম যেন। 

** এখানে কবি আরও অঙ্গীকারদীপ্ত সোচ্চার :

// নামমাত্র স্নান সারা হল। পাড় ভাঙা জখম 
নিয়ে 
অতিকষ্টে নদী বহে যায়...
হুমড়ি খাওয়া বটগাছ, আব্বাসউদ্দীন আর
বোবা জল নিয়ে...//


 * কবিতায়, গল্পের-আবহ তৈরি চন্দ্রনাথের বেশ 
কয়েকটি কবিতায় লক্ষনীয় ভাবে ধরা পড়েছে :

// ক্ষুরধার নরুন জানত--আজ পুণ্যিপুকুরে
ঘাটকামান। কোরা-জামাকাপড়ের গন্ধে ম-ম
ঘাটের পইঠা...সেখানে ভরা-বর্ষার ছলাৎ
আর কখনও ছোঁবেনা লাবণ্য...//
.                     [অশৌচ, নরুন আর নাপিত বউ]

কিংবা গ্রন্থের শেষ কবিতা : চিঁড়ে আর মুড়ির জবানিতে লেখা--'চিঁড়ের-কৌটোয় আমি চিঁড়ে' :

// চিঁড়ের-কৌটোয় আমি চিঁড়ে
           মুড়ির-কৌটোয় মুড়ি
অনার্য মেয়ে মানুষ তাতে মিশিয়ে দিচ্ছে 
ছোলা-বাদাম ভাজা ; মুখরোচক হবে বলে 
কুসুমদানা...

আমরা হাওয়াবদলে যাব...

বাবুদের বছরে দু-বার বাতিক--ভূভারত পর্যটন
সসাগরা পাহাড়-সমুদ্র--ডুয়ার্স ডেড়েমুষে

আমরা নেতিয়ে পড়ি, ওঁরা 
চাঙ্গায়নী সুধা...//

* গোটা কবিতাটির মধ্যে একটা সাটায়ারধর্মী  
আত্মজৈবনিক আলো এসে বিষাদক্লিষ্ট  করে 
পাঠককে! দিব্যি বুঝতে পারে দীক্ষিত পাঠক--
চিঁড়ে আর মুড়ি--পরের বাড়িতে খেটে খাওয়া হত
দরিদ্র কাজের মাসিদের-ই প্রতিনিধিত্ব করছে।( 'অনার্য মেয়েমানুষ ') শব্দটির ব্যবহার লক্ষ্য 
করুন। কবিতাদু'টিতে--যুগপৎ প্রচ্ছন্ন তিরস্কার এবং অশ্রুকণা ঝিকমিক করে উঠেছে!

*এছাড়া, চন্দ্রনাথ শেঠের চব্বিশ পাতার এই 
কবিতার বইটি আমার কাছে শারীরিক ঘনিষ্ঠতার অমল এক উন্মাদনা! সরাসরি কবিতায় চলে যাই :

//যক্ষরাত্রিতে এসো। রাস সাজিয়ে বসে থাকব। 
আমরা। তোমার বিরহী--কদম্ব গাছ এক পায়ে
খাড়া হয়ে রয়েছে ঠায়...মাথাভর্তি পোকা
কদম-রেণুর রহস্য নিয়ে ঝরে পড়ে পাতায়
পাতায়। আকাশে জমে ওঠে গুহ্যকালীর
মতো কালো মেঘ...এসো
* *************************************** *
শুনতে পাও রিরংসাসঙ্গীত ? মুখ থেকে 
বেরিয়ে আসছে অনর্গল : দয়া করো...
এসো তীর বিদ্ধ করি। টেরাকোটা মিথুনেরা
সুগভীর আশ্লেষে থাক আজন্মকাল দু-জনে
দু-জন    //        ("যক্ষপ্রিয়া") 

--কবিতাটি ছোটো-বড়ো বাক্যে গড়া। সঙ্গীতময়
পঞ্চশর নিয়ে এগিয়ে আসছে যেন! আচ্ছা, 'যক্ষরাত্রি' কী? কার্তিক পূর্ণিমা বা রাস পূর্ণিমার-
রাত্রি। নামকরন পাঠেই যেন হাজার বাতির ঝারের আলো খেলে যায়! স্নিগ্ধ-শান্ত এক উন্মাদনার হিল্লোল এগিয়ে আসে। কোনো এক মন্দির গাত্রের
টেরাকোটা মিথুনের আশ্লেষাব্ধ মূর্তি মনে পড়িয়ে দেন কবি। অদ্ভুতসব শব্দচয়ন এবং চিত্রকল্পও : 'গুহ্যকালী', 'রিরংসাসঙ্গীত'! 

*তাঁর কবিতায়-- 'চেয়ে দেখার আনন্দ'ও অপরিসীম :
'অমাবস্যার দিগন্ত সাঁতরাতে' ("অমারাত্রি"/৫), 
'নুন চাখা ক্লিভেজের ঢেউ'("কবিজন্ম"/৬),
'শেষনাগ চোখ ' (ঐ/৬), 
'বালতির মধ্যে ডুবে থাকা মগ'("মগজীবন"/৭),
'কুচি আলোয় নেচে ওঠা ঘর'("ছট-২০১৮"/৯),
'সেলাই জীবন'(ঐ/৯),
'কলি চুলে রাঙানো রাত্রির দেওয়াল'(ঐ/৯),
'দু-বিঘে দলিল ওড়ে--তেরঙা পতপত'(২০১৯),
আতাবীজের মতো ছড়িয়ে লেখা শংশাপত্র'(ঐ/১০)---শ্লেষে-বিষাদে-স্নেহে , এভাবেই মাখামাখি চন্দ্রনাথের কবিতা।।