পৃ-১.[ "জি, জন্মান্তরীণ...."]
ক্যালিগ্রাফি <আকা/১২
স্মৃতি সাম্পান //
ঋদ্ধি ঘোষ [ পৃ--১]
" মাথায় উড়ছে উন্মাদ-পঙক্তিরা..."
""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""
সারাদিনের ব্যস্ততার তুঙ্গ থেকে নেমেও, বসতে ইচ্ছে করে প্রিয় পুস্তকের কাছে। মনে হয় সরাসরি
চলে যাই। দু দন্ড বসি। কবি চন্দ্রনাথ শেঠ-এর :
"জি, জন্মান্তরীণ এই আলপথে" তেমনই একটি বই। পাঠক হিসাবে এ বই পাঠ আবেশ থেকে মুক্তি
দেয় না মোটেও। টানা পক্ষকাল পড়ার পরও-- থেকে যায়--এক আনন্দঘন অভিজ্ঞতা। নিজেকে ছিন্ন করে নিতে পারি কই , আমি ? সুগভীর এক তন্ময়তায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি :
. মাথায় উড়ছে উন্মাদ পঙক্তিরা
. সন্ধ্যাতারাটি হেমলক বিষ হাতে...
. 'কাছে আয়!'--কাছে যাই
. অমাবস্যার দিগন্ত সাঁতরাতে
নূতন , মরমী, নিজস্ব এক কাব্যভাষায়--চন্দ্রনাথ মেলে ধরেছেন তাঁর কবিতার ডানা।
*মাত্র দেড় ফর্মার বই ; প্রকাশক--বহুদিনের ঐতিহ্যবাহী 'তাঁতঘর' পত্রিকা। বইমেলা-২০২০.
প্রচ্ছদের দৃষ্টিনন্দন ক্যালিগ্রাফিটি করেছেন--
নবীন-কবি সম্পাদক শুভদীপ সেনশর্মা।
*গভীর তন্ময়তায় গ্রন্থিত হয়ে পড়ি বইটির সাথে।পড়ে যাই , ঘোরলাগা সেইসব পঙক্তি :
ক> এইতো লিখছি--
. রাত্রি লাগা ঢেউ...
. বেঘোরে মরে যাওয়া বিধ্বস্ত নদী
. ফ্ল্যাটবাড়ি প্রিয়-খেলামাঠ...
. ('কবিজন্ম')
খ> সারারাত ভরা বালতির মধ্যে ডুবে থাকা মগ
. তার তো ডোবার কোনো সাগর নেই
(মগ-জীবন)
গ> দোতারাজীবন ছিল ঘরে ঘরে বেজে উঠতিস
ছিল মুদ্রণপ্রমাদে ভরা মাথার আকাশ...
(প্রত্নলেখ)
ঘ> ইঞ্চিকয় সেলাই-জীবন...
ভাই-বোনে মিলে কলিচুনে রাঙিয়েছ কালো
রাত্রি-দেয়াল...এসো শব্দ নিশিভোর
জি, জন্মান্তরীন..../(পৃ--২.)
১ ২ ২ ১ | ২ ২ ২ | ১ ১= ৬+৬+২
u --- --- u | --- --- --- |u u
মা থায়্ উড়্ ছে | উন্ মাদ্ পঙ্ তি রা
২ ১ ১ ১ ১ | ২ ২ ২ ১ ১
--- u u u u | --- --- ---- u u
সন্ ধা তা রা টি | হেম্ লক্ বিষ্ হা তে
১ ১ ২ ১ ১ ২
u u --- u u ---
কা ছে আয়্ ---কা ছে | যাই্
১ ১ ২ ২ | ১ ২ ১ ২ | ১ ১
u u --- --- u --- u ---- | u u
অ মা বস্ স্যার্ | দি গন্ ত সাঁত্ | রা তে
* এখানে সমস্ত রুদ্ধ (আদি, মধ্য, অন্ত)-দল দু'মাত্রার হয়েছে। এই হিসেবে সমান্তরালস্থ পর্বগুলোর মাত্রার হিসাব :
চরণ--
১---> প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বে : ৬ মাত্রা, তৃতীয় বা প্রান্তিক পর্বে : ২ মাত্রা।
২---> প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বে : ৬ মাত্রা, তৃতীয় বা
প্রান্তিক পর্বে : ২ মাত্রা।
৩---> প্রথম পর্বে : ৬ মাত্রা, দ্বিতীয়, তৃতীয় :
২ মাত্রা।
৪---> প্রথম পর্বে : ৬ মাত্রা, দ্বিতীয়, তৃতীয় :
২ মাত্রা।
এর ফলে সমান্তরাল পর্বগুলোর পর্বসমতা দক্ষতার সঙ্গে রক্ষা করেছেন কবি।
বিন্যাস ঘটিয়েছেন : ৬ | ৬ | ২
. ৬ | ৬ | ২
. ৬ | ২
. ৬ | ৬ | ২
রীতি : কলাবৃত্ত ( মাত্রাবৃত্ত )। লয় : বিলম্বিত না
বলে ধীর বলাই শ্রেয়।
*এবার তাঁর কবিতার ক্রম অতিক্রমী চেহারার কথা বলা যাক।পূর্বজ দুটি কাব্য('ঝরনা কলম' এবং 'কাঠবাদামের মালা')-বৃত্তের বাইরে আসতে
পেরেছেন তিনি? এর উত্তর আপাতদৃষ্টিতে দেওয়া
কঠিন। তবু দেখা যাক। প্রথমেই তাঁর বিষয় বৈভবের কথা বলি :
অমারাত্রি, কবিজন্ম, মগ জীবন, ছট-২০১৮, ২০১৯, জি, এই আলপথ জেগে, পে টয়লেট, লাঞ্চ ব্রেক, পাল উড়াইয়া দে--কবিতাগুলি সম সাময়িক ইতিহাসের দলিল। পড়ুন :
* // এইতো লিখছি :
. রাত্রি লাগা ঢেউ...
. বেঘোরে মরে যাওয়া বিধ্বস্ত নদী
. ফ্ল্যাটবাড়ি প্রিয়-খেলামাঠ...//
. (কবিজন্ম)
কৈশোরের-রম্য স্থানগুলি আজ--রক্তাত্ব, বিধ্বস্ত অথবা পুরোপুরি বিলুপ্ত। সেকথা লিখতে কবি যেন বদ্ধপরিকর। শুধু এই জন্যই তাঁর কবিজন্ম যেন।
** এখানে কবি আরও অঙ্গীকারদীপ্ত সোচ্চার :
// নামমাত্র স্নান সারা হল। পাড় ভাঙা জখম
নিয়ে
অতিকষ্টে নদী বহে যায়...
হুমড়ি খাওয়া বটগাছ, আব্বাসউদ্দীন আর
বোবা জল নিয়ে...//
* কবিতায়, গল্পের-আবহ তৈরি চন্দ্রনাথের বেশ
কয়েকটি কবিতায় লক্ষনীয় ভাবে ধরা পড়েছে :
// ক্ষুরধার নরুন জানত--আজ পুণ্যিপুকুরে
ঘাটকামান। কোরা-জামাকাপড়ের গন্ধে ম-ম
ঘাটের পইঠা...সেখানে ভরা-বর্ষার ছলাৎ
আর কখনও ছোঁবেনা লাবণ্য...//
. [অশৌচ, নরুন আর নাপিত বউ]
কিংবা গ্রন্থের শেষ কবিতা : চিঁড়ে আর মুড়ির জবানিতে লেখা--'চিঁড়ের-কৌটোয় আমি চিঁড়ে' :
// চিঁড়ের-কৌটোয় আমি চিঁড়ে
মুড়ির-কৌটোয় মুড়ি
অনার্য মেয়ে মানুষ তাতে মিশিয়ে দিচ্ছে
ছোলা-বাদাম ভাজা ; মুখরোচক হবে বলে
কুসুমদানা...
আমরা হাওয়াবদলে যাব...
বাবুদের বছরে দু-বার বাতিক--ভূভারত পর্যটন
সসাগরা পাহাড়-সমুদ্র--ডুয়ার্স ডেড়েমুষে
আমরা নেতিয়ে পড়ি, ওঁরা
চাঙ্গায়নী সুধা...//
* গোটা কবিতাটির মধ্যে একটা সাটায়ারধর্মী
আত্মজৈবনিক আলো এসে বিষাদক্লিষ্ট করে
পাঠককে! দিব্যি বুঝতে পারে দীক্ষিত পাঠক--
চিঁড়ে আর মুড়ি--পরের বাড়িতে খেটে খাওয়া হত
দরিদ্র কাজের মাসিদের-ই প্রতিনিধিত্ব করছে।( 'অনার্য মেয়েমানুষ ') শব্দটির ব্যবহার লক্ষ্য
করুন। কবিতাদু'টিতে--যুগপৎ প্রচ্ছন্ন তিরস্কার এবং অশ্রুকণা ঝিকমিক করে উঠেছে!
*এছাড়া, চন্দ্রনাথ শেঠের চব্বিশ পাতার এই
কবিতার বইটি আমার কাছে শারীরিক ঘনিষ্ঠতার অমল এক উন্মাদনা! সরাসরি কবিতায় চলে যাই :
//যক্ষরাত্রিতে এসো। রাস সাজিয়ে বসে থাকব।
আমরা। তোমার বিরহী--কদম্ব গাছ এক পায়ে
খাড়া হয়ে রয়েছে ঠায়...মাথাভর্তি পোকা
কদম-রেণুর রহস্য নিয়ে ঝরে পড়ে পাতায়
পাতায়। আকাশে জমে ওঠে গুহ্যকালীর
মতো কালো মেঘ...এসো
* *************************************** *
শুনতে পাও রিরংসাসঙ্গীত ? মুখ থেকে
বেরিয়ে আসছে অনর্গল : দয়া করো...
এসো তীর বিদ্ধ করি। টেরাকোটা মিথুনেরা
সুগভীর আশ্লেষে থাক আজন্মকাল দু-জনে
দু-জন // ("যক্ষপ্রিয়া")
--কবিতাটি ছোটো-বড়ো বাক্যে গড়া। সঙ্গীতময়
পঞ্চশর নিয়ে এগিয়ে আসছে যেন! আচ্ছা, 'যক্ষরাত্রি' কী? কার্তিক পূর্ণিমা বা রাস পূর্ণিমার-
রাত্রি। নামকরন পাঠেই যেন হাজার বাতির ঝারের আলো খেলে যায়! স্নিগ্ধ-শান্ত এক উন্মাদনার হিল্লোল এগিয়ে আসে। কোনো এক মন্দির গাত্রের
টেরাকোটা মিথুনের আশ্লেষাব্ধ মূর্তি মনে পড়িয়ে দেন কবি। অদ্ভুতসব শব্দচয়ন এবং চিত্রকল্পও : 'গুহ্যকালী', 'রিরংসাসঙ্গীত'!
*তাঁর কবিতায়-- 'চেয়ে দেখার আনন্দ'ও অপরিসীম :
'অমাবস্যার দিগন্ত সাঁতরাতে' ("অমারাত্রি"/৫),
'নুন চাখা ক্লিভেজের ঢেউ'("কবিজন্ম"/৬),
'শেষনাগ চোখ ' (ঐ/৬),
'বালতির মধ্যে ডুবে থাকা মগ'("মগজীবন"/৭),
'কুচি আলোয় নেচে ওঠা ঘর'("ছট-২০১৮"/৯),
'সেলাই জীবন'(ঐ/৯),
'কলি চুলে রাঙানো রাত্রির দেওয়াল'(ঐ/৯),
'দু-বিঘে দলিল ওড়ে--তেরঙা পতপত'(২০১৯),
আতাবীজের মতো ছড়িয়ে লেখা শংশাপত্র'(ঐ/১০)---শ্লেষে-বিষাদে-স্নেহে , এভাবেই মাখামাখি চন্দ্রনাথের কবিতা।।
এমন পুঙ্খানুপুঙ্খ ও নিবিড়পাঠের প্রত্যাশায়
উত্তরমুছুনবসে থাকেন একজন কবি।
শুভেচ্ছা
শতদল।
আলোচনা খুব ভালো লাগলো।
উত্তরমুছুনআগ্রহ বেড়ে গেল বইটি পড়ার।
মনোজ্ঞ নিবিড় আলোচনা। বিশেষত ছন্দের ব্যাকরণ ও বিশ্লেষণ আলোচনায় আলাদা মাত্রা এনে দিয়েছে। পাঠকের কাছে নিঃসন্দেহে বড় পাওনা।
উত্তরমুছুনকবিতার অসীমে প্রাণমন লয়ে ঋদ্ধির ঋত্বিক। নতুন ভাষা দিগন্ত পেল কবির অসাধারণ কবিতাগুলো। কুর্নিশ কবিকে ও আলোচককে
উত্তরমুছুনঅত্যন্ত পরিশীলিত আলোচনা।এই আলোচনা পড়ে মনে হল কবি ও আলোচক দুজনেই কবিতার জগতে বিস্তর ভ্রমণ করেন।খুব সুন্দর
উত্তরমুছুন