মুক্তগদ্য: অরুন্ধতী সাহা গুপ্ত

 






অরুন্ধতী সাহা গুপ্ত


মাঘী মেঘমায়া


বেশ একটা মেঘলা আবহাওয়া।বৃষ্টি নেই যদিও ।শাশুড়িমা থাকলে বলতেন "আইর বিষ্টি হওন লাগে নাআ"---।এখন মাঝে মাঝেই আমার গণ্ডগোল হয়ে যায় দুটো জিনিসে।কত তারিখ আর কি বার।খুব প্রয়োজন হলে একে তাকে জিজ্ঞেস করি।মোবাইলে দেখে নিলেও হয়।দেখি না।আসলে যাকে প্রশ্ন করি, উত্তর দিতে গিয়ে তার মুখের ভাবটা দেখি তাকিয়ে তাকিয়ে।সে যদি আমতা আমতা করে তো বেশ আমোদ বোধ হয়।এই তো!আমি একা না তা'লে---


আজ মাছ মাংস ছিলো না রান্না করার মতন।সব্জিও ফ্রিজে বাড়ন্ত।থাকার মধ্যে গাদা খানেক বিনস।গাজর।আলু পেঁয়াজ লঙ্কা আদা রসুন।পেল্লাই বেগুন পাঁচটা।পেট ফুলো।গোলগাল।টমেটো কিছুটা। 

কালকের বেঁচে যাওয়া পাঁচমিশেলি তরকারি আর ছোলার ডাল দিয়ে রুটি খেয়ে নিতে হলো।ভাত বসিয়ে দিলাম এবার।ভাতের হাঁড়িতে চাল মেপে দিয়ে-তার ওপর একটা বড় গামলায় জল ভরে রেখে সেটার ওপর হাঁড়ির মুখের ঢাকনাটা চাপিয়ে দি।ভাত ফুটতে ফুটতে সেই জলও কষকষে গরম হয়ে যায়।সেই গরম জলের কিছুটা একটা বাটিতে ঢেলে তাতে ক'টা ডিম সেদ্ধ হতে দিয়ে চলে এলাম বাগানে। শিমগাছে ভর্তি শিম।তুলে নিলাম বেশ একঝুড়ি।পেছনের বাড়ির বৌদি পুজোর ফুল তুলতে তখন বাইরে।কথা চালাচালি করতে করতে কিছুটা শিম প্যাকেটসমেত বেড়ার সীমানা পার হলো সেই ফাঁকেই।ধনেপাতা তুল্লাম।মুলো।শাক সমেত।লঙ্কা কয়েকটা।ছিলো ঘরে।তবু।ধনেপাতা,লঙ্কা আর দু চামচে পোস্ত দিয়ে মাখোমাখো করে বেটে নিলাম।সেটা ছোট্ট বাটিতে করে ফ্যান গালা হয়ে গেলে হাঁড়ি তুলে নিয়ে  ভাতের মাঝখানে গোল ফুটো করে বসিয়ে দেব।খাবার সময় তাতে পড়বে একটু নুন আর বেশ খানিকটা কাঁচা সর্ষের তেল।ঝাঁজ নিলেই আস্বাদ জিভেও ছড়াবে।মুলো কুচি করে ঘণ্ট।তাতে মটরশুঁটি।তেজপাতা আর শুকনো লঙ্কাফোড়ন।মুলোশাক কেটে নুন দিয়ে ভিজিয়ে রেখেছিলাম সেই গামলার গরম জলেই।সেটা নরম হয়ে এল ইতিমধ্যে।একফালি বেগুন খুব ছোটো ছোটো করে কেটে ভেজে তুলে নিলাম। ঐ তেলেই রসুনকুচি লঙ্কা দিয়ে নরম হয়ে আসা শাক দিয়ে দিলাম।জল মজে এলো।এবার দিলাম নুন হলুদ আর একটু মিষ্টি।পুজোর থালা থেকে তুলে রাখা একটা গুড়ের বাতাসার অর্ধেক।নাড়তে থাকি।এক সময় তেলতেলে হয়ে এলে ভেজে নেওয়া লালচে বেগুনকুচি এবার মেশে।একটু  কম আঁচে রেখে শাক বেগুনে মেলামেশা করতে দি।তারপর বাটিতে তুলে ঢাকা।


ডিমের খোসা ছাড়িয়ে তাতে লম্বা লম্বা দাগ কাটতে আমার খুব ভালো লাগে।সাদাখোলার একটা টুকরো তুলে নিই।ছুরির চেয়েও ভালো কাটে তাতে।মোলায়েম ভাবে ডিমের বুকের কুসুম অবধি চিরে ফেলা যায় একটানে।আগে অবাক লাগতো খুব।দামি ধারালো ছুরির চেয়েও মসৃণ এই কাটা!এখন আর অবাক হই না।যা নিজের,যা একান্ত আপনার তার দেওয়া আঘাতই তো এমন গহনে যেতে পারে।সমস্ত রুহের অন্তস্থলে।বোঝাই যায় না কখন যেন রক্তক্ষরণ ছাড়াও রক্তাক্ত করে দিয়েছে ভিতরে ভিতরে।

ডিম ভেজে তুলি।পেঁয়াজ একটু মোটা করে লম্বা লম্বা কেটে রেখেছিলাম।তেল গরম করে কালোজিরে।এক চামচ।বেশ এত্তটা।পুটপুট হচ্ছিল।পেঁয়াজগুলো দিলাম। কি দারুণ গন্ধ পেঁয়াজ ভাজার।বেশ ভাজা হয়ে এলে ভাজা ডিমগুলো ছেড়ে দিয়ে ন'দশটা রসুন থেঁতো করে দিয়ে আরো একটু ভাজ্লাম।এবার গন্ধের পরিবর্তন।আরেকটু হলুদ দিলাম।আর শুকনো মরিচ বাটা।ভেজেভুজে জলছিটে।সামান্যই।এতেই পাকে পাকে জড়াবে ডিমের শরীর পেঁয়াজের সাথে।জারিয়ে জারিয়ে ভেতর অবধি পৌঁছে যাবে।যেমন করে আমাদের হৃদয়ের ক্ষতের অবকাশে ঢুকে পড়ে কিছু কিছু স্বাদু প্রলেপ।জীবন আরো কুসুমের মত বিদীর্ণ হয়েও আস্বাদিত হবার অপেক্ষা করে। কপালের কথা কেই বা জানে!কপাল শব্দ এলেই  'পোড়া' শব্দটাও পাশাপাশি মনে এসেই যায়।


বিকেলে রুটির সাথে কিন্তু বেগুনপোড়া।পোড়া টমেটোও থাকবে সাথে।বেশ করে কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ?ধনেপাতা মিলিয়ে খোলতাই হবে হাতে গড়া রুটির সাথে।থাকবে একটু ঝিরিঝিরি---না না--বৃষ্টি কিংবা হাওয়া নয়--আলুভাজা।


হাতের তালু থেকে বেগুনপোড়ার গন্ধ আসে।নখে হলুদ ছোঁয়া।রোদে পিঠ দিয়ে তবু বড় ভালো লাগে।মনে হয় বেড়ে দেওয়া  ভাত ''অন্ন'  হয়ে উঠুক ঘরে ঘরে।উদ্বৃত্তটুকু পেয়ে এক ঠ্যাঙা শালিক,পোষা ভুলু আর ছিটঘুঘুটিও আবার যেন  চাতালের সিঁড়িটির পাশে ফিরে ফিরে আসতে চায়।


অল্প গান শুনবো এবার।ভানুসিংহ---

তারপর উঠে যাবো হয়তো অন্য কোনো কাজে।

"বচন মৃদু মরমর

কাঁপে রিঝ থরথর,

শিহরে তনু জরজর

কুসুমবনমাঝ।

মলয় মৃদু কলয়িছে ,

চরণ নহি চলয়িছে,

বচন মুহু খলয়িছে,

অঞ্চল লুটায়"।