স্বর সুর ধ্বনি ধ্যান : চন্দ্রদীপা সেনশর্মা

 





চন্দ্রদীপা সেনশর্মা


স্বর সুর ধ্বনি ধ্যান


ফেব্রুয়ারি ৬ এবং ১৫ তারিখে প্রয়াত হলেন দুই অবিস্মরণীয় সংগীতশিল্পী, লতা মঙ্গেশকর এবং
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। যাঁদের গান শুনতে শুনতে ছোট থেকে বড়ো হয়ে ওঠা।

বম্বে টকিজ়-এর রিহার্সাল রুমে অনিল বিশ্বাস ক্ষেমচন্দ প্রকাশ হুসেনলাল ভগৎরাম নওশাদের
সামনে লতাকে নিয়ে এসেছিলেন গুলাম হায়দর। লতা গাইলেন এবং উত্তীর্ণ হলেন। প্রথম সুযোগ
দিলেন নওশাদ। পরে অন্যরাও। 'বরসাত' ফিল্মে লতা দু'জন নায়িকার গান একাই গেয়েছিলেন
শঙ্কর-জয়কিষনের সুরে। গানগুলি, বিশেষ করে 'জিয়া বেক়রর হ্যায়' এখনও সমান জনপ্রিয়। এই
জনপ্রিয়তা তাঁকে ধীরে ধীরে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে দেয়। পারিবারিক ঐতিহ্যে লতার সংগীত-শিক্ষা
শুরু বাবা দীননাথ মঙ্গেশকরের কাছে (গ্বালিয়র ঘরানা)। বম্বেতে লতা তালিম নেন আমন আলি
খান এবং পরে আমানত আলির কাছে। প্লে-ব্যাক শিল্পীর খ্যাতি পেলেও তিনি ধ্রুপদি সংগীতশিল্পী
হতে চেয়েছিলেন।

নায়িকার ব্যক্তিত্ব, গানের প্রতিটি শব্দের অর্থ, কম্পোজ়ারের মনোভাব বুঝে হিন্দি সিনেমার গানে
লতা মঙ্গেশকর গায়কীর নতুন আঙ্গিক নিয়ে এলেন, যা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। 'অ্যায় মেরে ওয়াতন কে
লোগোঁ' কথা: প্রদীপ, সুর: সি রামচন্দ্র। দিল্লিতে ১৯৬৩-র ২৬ জানুয়ারি গানটি গাওয়ার পর
প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু লতাকে বলেছিলেন, 'বেটা, তুমনে আজ মুঝে রুলা দিয়া'। কবি ও
সুরকারের প্রতি সম্মানে লতা যে কত সংবেদী, গানটি শুনলে বোঝা যায়। আজও আমরা যখন
এই গান শুনি অশ্রু সংবরণ করতে পারি না। 'মহল'-এর 'আয়েগা আনেওয়ালা', 'আনারকলি'-র
'ইয়ে জ়ীন্দগী উসী কী হ্যায়', 'মুগ়ল-এ আজ়ম'-এর 'মোহে পনঘট পে' একের পর এক অতুলনীয় গান।
দশকের পর দশক ধরে লতা হিন্দি সিনেমার প্রতিটি অভিনেত্রীর কণ্ঠ হয়ে উঠেছেন। শোভনা
সমর্থ, নূতন তনুজা এবং কাজল তিন প্রজন্মের গান লতা গেয়েছেন। সত্তর ছুঁই ছুঁই বয়সে তিনি
কাজলের লিপে গাইছেন, 'তুঝে দেখা তো ইয়ে জানা সনম', যেন কুড়ির যুবতী।

মৌলবি রেখে উর্দু শেখায় সাহির লুধিয়ানভি মজরুহ্ সুলতানপুরী শৈলেন্দ্র শাকিল বদায়ুনি
ক্যাইফি আজ়মি রাজা মেহদি আলি খান গুলজ়ার জাবেদ অখ্তার এঁদের লেখা প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে
তাঁর কণ্ঠে। অত্যন্ত মননশীলতায় তিনি মদনমোহন শচীনদেব বর্মন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সলিল
চৌধুরীর ভিন্ন ভিন্ন কম্পোজ়িশনে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছেন। পরে রাহুলদেব বর্মন থেকে এ আর
রহমান এর ব্যতিক্রম ঘটেনি।

'অভিমান' ফিল্মে 'নদীয়া কিনারে' শচীনদেব বর্মনের সুরে, ওঁর সুরেই 'আজ ফির জীনে কী'--
অসাধারণ! 'রৈনা বীতী জায়ে' ধ্রুপদি নির্ভর কঠিন সুর রাহুলদেব বর্মনের, লতা ছাড়া কে গাইবেন?
সলিল চৌধুরীর সুরে 'ও সজনা', 'না জানে কিউ' কি ভোলা যায়? বাঙালি সুরকারের হিন্দি
কম্পোজ়িশন গাইতে গাইতে তিনি বাংলার মেঠো সুর কীর্তনের ভাব আয়ত্ত করে নিয়েছিলেন। বাংলা
গান গাওয়ার সময় অনায়াসে সঠিক ভাবটি কণ্ঠে তুলে আনতেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে
'বাঘিনী'র 'যদিও রজনী' গানে 'বলে বলুক লোকে মানি না মানি না/ কলঙ্ক আমার ভালো লাগে' এই
অংশ নান্দনিক বিরহে বুকে যেন তিরের মতো এসে বিঁধে যায়।

নিঃসন্দেহে লতা মঙ্গেশকর-মদনমোহন শ্রেষ্ঠ জুটি। কোন গান ছেড়ে কোন গানের কথা বলি। 'নৈনোঁ মে বদরা ছায়ে', 'আপকি নজ়রোঁ নে সমঝা', 'লগ যা গলে', 'তু জহাঁ জহাঁ চলেগা', 'বৈয়াঁ না ধরো' যেমন
সুর তেমন গেয়েছেন লতা। খৈয়ামের সুরে দুটি  'অ্যায় দিল-এ নাদান', লেখক জাঁ নিসার অখ্তার,
'দিখাঈ দীয়ে ইউঁ', লেখক মীর তকি মীর, জগজিৎ সিং এর সুরে 'দর্দ সে মেরা দামন ভর দে', লেখক
কতীল শিফাই--তিনটি গ়জ়লেই লতার গায়কী যে গভীর ধ্যানে পৌঁছে যায়, হয়তো তাই ঈশ্বর! লতা
মঙ্গেশকর সত্যিই সরস্বতীর প্রতিরূপ।

                                     ২

সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ধ্রুপদি সংগীতের তালিম নেন যামিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে। সন্তোষকুমার বসু,
এ টি কানন, চিন্ময় লাহিড়ী এঁদের কাছেও প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। ১৯৪৬ সালে 'গীতশ্রী' পরীক্ষায়
প্রথম হন। বিচারক ছিলেন উস্তাদ আলাউদ্দিন খান, উস্তাদ মহম্মদ দবির খান, রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রমুখ। পরবর্তী সময়ে সন্ধ্যা নাড়া বেঁধেছিলেন উস্তাদ বড়ে গুলাম আলি খানের কাছে।
উস্তাদজী'র মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র মুনাবর আলি খানের কাছে তিনি শিখেছেন। ধ্রুপদি শিল্পী হিসাবে
তিনি অনুষ্ঠান করেছেন। অন্যদিকে রাগপ্রধান গান ভজন আধুনিক গান এবং নেপথ্যসংগীতের
জগতেও তিনি ছিলেন অসামান্য। শুধু বাংলা নয় তিনি বেশ কিছু হিন্দি সিনেমাতেও প্লে-ব্যাক
করেছেন। হিন্দি সিনেমা 'তারানা'য় সন্ধ্যা প্রথম প্লে-ব্যাক করেন। গানটি 'বোল পাপিহে বোল' সুর
অনিল বিশ্বাসের, লতার সঙ্গে যুগলকণ্ঠে। ১৯৫০-১৯৫২ বোম্বেতে কাটিয়ে, ১৭টি হিন্দি
সিনেমায় গান গেয়ে ফিরে এলেন কলকাতা।

বাংলা গানের স্বর্ণযুগের শিল্পী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, বহু প্রতিভার সমাগমেও নিজস্ব গায়নশৈলিতে
ছিলেন অনন্য। আমার সৌভাগ্য ছোটবেলা রেকর্ডপ্লেয়ারে ধ্রুপদি সংগীত শুনেই কেটেছে।
সঙ্গে রেডিয়ো এবং সংগীতের অনুষ্ঠান দেখতে যাওয়া তো ছিলই। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে
আমাদের চর্চার পরিসরটি অনেক বেশি বিস্তৃত ছিল। আমরা ওঁর গুণমুগ্ধ ভক্ত ছিলাম। গাঙ্গুবাঈ
হাঙ্গল কেসরবাঈ কেরকর বেগম অখ্তার এঁদের সঙ্গে একইরকম শ্রদ্ধায় সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান শুনতাম।

রবীন চট্টোপাধ্যায় নচিকেতা ঘোষ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে সন্ধ্যা ছিলেন অতুলনীয়। তবে
হেমন্ত-সন্ধ্যা জুটি এবং উত্তম-সুচিত্রা জুটি ছিল সমার্থক। সুচিত্রা সেনের লিপে ওঁকে ছাড়া অন্য
কোনো শিল্পীকে ভাবা যেত না। 'অগ্নিপরীক্ষা' সিনেমায় 'গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু' গানটির প্রতি
অভূতপূর্ব আকর্ষণ এখনও কিছুমাত্র কমেনি। ওই গানে সন্ধ্যা গলায় সুরের অদ্ভুত অনুরণন
এনেছিলেন, বিশ্বাস করুন ওই অনুরণনের মুগ্ধ শ্রোতা আমি। লতার মতো সন্ধ্যাও ছিলেন
ভার্সাটাইল। যেমন অগ্নিপরীক্ষায় 'কে তুমি আমারে ডাকো' গানের মেজাজ 'গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু'
থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। 'সপ্তপদী' সিনেমার বিখ্যাত গান যেখানে লালা লা লা ছাড়া কিছুই করেননি সন্ধ্যা, কিন্তু ওটুকুতেই সুচিত্রা সেন অভিনীত রিনা ব্রাউনের খুশি আনন্দ রোমান্টিক আবেদন উপচে পড়েছে।

'মধুমালতী ডাকে আয়/ ফুল ফাগুনের এ খেলায়' গানটি শুনলে মনে হয় ফাগুন যেন সব সৌন্দর্য
নিয়ে ঝরে পড়েছে। 'আকাশের অস্তরাগে' এই গানটির অন্তরায়, 'আজ কান পেতে শুনেছি আমি/
মাধবীর কানে কানে কহিছে ভ্রমর আমি তোমারই' আহা কী মাধুর্য কণ্ঠে, যেন সত্যি কান পেতে
শুনছেন। বাংলার ঘরে ঘরে লক্ষ্মীপুজোয় যে কোনো মন্ত্রের থেকেও তাঁর গাওয়া 'এসো মা লক্ষ্মী
বসো ঘরে' অনেক বেশি আদরের। সহজ সরল ঘরোয়া আবাহন। এ গানের বিকল্প আজও আমরা
খুঁজে পাইনি। 'চম্পা চামেলি গোলাপেরই বাগে' মান্না-সন্ধ্যা জুটির অনবদ্য গান! 'শ্রাবণ অঝোর
ঝরে', 'আয় বৃষ্টি ঝেঁপে', 'উজ্জ্বল একঝাঁক পায়রা', 'গহন রাতি ঘনায়' সলিল চৌধুরীর সুরে আমরা
পরিচিত শৈলির বাইরে এক অন্য সন্ধ্যাকে খুঁজে পাই। 'আমাদের ছুটি ছুটি' গানের আনন্দ ভাষায়
বর্ণনাতীত। এই গানটি এবং নিশিপদ্ম সিনেমার অসামান্য গান 'ওরে সকল সোনা মলিন হল'
শিল্পীকে জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত করে। 

                                   ৩

'বাহোঁ মেঁ চলে আও' ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে গাইছেন নায়িকা, ঘুমের আবেশ বোঝাতে হাফটোনে
গাইলেন লতা। 'ঘুম ঘুম চাঁদ ঝিকিমিকি তারা' সন্ধ্যা ঘুমের আবহেই প্রেমের আবেদন ফুটিয়ে তুললেন।
গানের ধরন আলাদা তবু কোথাও যেন দু'জন শিল্পী এক হয়ে গেলেন। পাশ্চাত্য ধ্রুপদি এবং
পাশ্চাত্য সংগীতে দু'জনেরই আগ্রহ ছিল। লতা বেঠোফেন মোৎজ়ার্ট  চাইকভস্কি'র সুর পছন্দ
করতেন। সৌমিত্র রায় সন্ধ্যা সম্পর্কে লিখছেন, 'একবার একটা অপূর্ব ব্যালাড শুনিয়েছিলেন আমাদের।'*

ভারতীয় সংগীতজগতের দুই সুরসম্রাজ্ঞীকে বিনম্র প্রণাম জানাই।
-------
*ঋণ: আনন্দবাজার পত্রিকা