মুক্তগদ্য : শুভ্রাশ্রী মাইতি

শনিবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০২২ /
ফেসবুক-এ শেয়ার করুন /
টুইটার-এ শেয়ার করুন

 






শুভ্রাশ্রী মাইতি


পাখিগানের মলাট 

 

 পাখি চিনতে শিখেছিলাম দাদুর হাত ধরে প্রথম। তখন বয়স চার কি পাঁচ হবে। লেসের ফ্রিল দেওয়া তুলতুলে ফ্রক পরে দাদুর হাত ধরে হাঁটতে বেরোতাম ভোর ছুঁয়ে। শিশিরভেজা দুব্বো ঘাসে ডুবে যেত ছোট ছোট পায়ের পাতা। নরম ফ্রকের আদরে জড়িয়ে থাকত মায়ের গায়ের মিষ্টি গন্ধ। ভারি পছন্দের ওই জামাগুলোর নাম দিয়েছিলাম  'পরিজামা'।
            বাড়ির পেছনে ক্যানেলের পাড় ছুঁয়ে চলে যাওয়া ছায়া টুবটুব মাটির রাস্তাটা ধরে হেঁটে যেতাম আমরা দুজন রোজ। কচুরিপানার সবুজ চাদরে মোড়া মজে ওঠা ক্যানেলটাকে মনে হত বইয়ের পাতায় আঁকা ভরভরন্ত কোন নদী। দাদু শোনাত পালতোলা নৌকার গল্পকথা। সেসব গল্পের ছলাৎছল শব্দে জানা, অজানা পরিযায়ী পাখির দল ভিড় করে আসত আমাদের চারপাশে। শালিখ আর চড়ুইয়েরা  উড়ুৎ ফুড়ুৎ ঝগড়া বাঁধাতো খুব। ওদের ঝগড়ার বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করলেই, দাদু আঙুল তুলতো জাফরিকাটা নরম রোদের দিকে। রোদ নিয়ে ঝগড়া !  অবাক হতাম খুব। এখন এই পরিণত বয়সে পৌছে মনে হয়, আমরাও যদি এমনই ক্ষমতা নয়, রোদের ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে ঝগড়া করতে পারতাম দুষ্টু পাখিগুলোর মতো, পৃথিবীতে অন্ধকার ঘুচে যেত কবেই। 
        মাঝে মাঝে আমাকে চমকে দিয়ে কোথা থেকে যেন উড়ে আসত একঝাঁক ঘন সবুজ টিয়া...তাদের টুকটুকে লাল ঠোঁটের ভাষায় লেখা থাকত কোন এক এক অজানা দেশের আশ্চর্য সব রূপকথা। সে দেশের ইতিহাস, ভূগোল কিছুই জানতাম না সেই আধো আধোবেলায়...তবু কোথায় যেন বড় আপনার বলে মনে হত তাকে। আমার চোখ পিটপিট করা মিনি পুতুলটার মতো আঁকড়ে রাখতে ইচ্ছে হত খুব বুকের মাঝে।
        সেই কমলাফুলী রোদের মিষ্টি ভোরগুলোয় পিঠে বইয়ের দশমণী ব্যাগ আর গলায় ঝাঁ-চকচকে ওয়াটার বটল ঝুলিয়ে স্কুলে যাওয়ার তাড়া ছিল না মোটেও। আমাদের সেইসব আনস্মার্ট যুগে শৈশব ছিল ঠিক এক খোলামেলা বাগানের মতো। সেখানে স্বচ্ছন্দে বয়ে যেত একটা ফুলকুড়ানো নদী, জোনাক থইথই মাঠে ছায়াগাছ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকত দাদু আর বাবা শক্ত ডালপালা মেলে। মা, ঠাকুমা, দিদিমারা  বিছিয়ে রাখত পাতার আঁচল। আর আমরা ইচ্ছেমত পাপড়ি মেলা ফুল বা কিচিমিচি পাখি হয়ে হাসি-গানে ভরিয়ে তুলতাম চারপাশ। জোছনা আর রোদ এসে আমাদের ঝামর চুলে আলোর ঝালর পরিয়ে যেত স্নেহভরে। মেঘ আর বৃষ্টি আলতো হাতে ছুঁয়ে যেত আমাদের চোখ ...যাতে স্বপ্নের ভেতর বার বার ফিরে আসে সেই সোনার কাঠি-রূপার কাঠির দেশের বাসমতি সুঘ্রাণ...বাবা, দাদুর কাছ থেকে উপহার পাওয়া রঙচঙে, নতুন বইয়ের গন্ধের মতো। খুব যত্ন করে বইয়ের মলাট পরাতো দাদু। ছুরি, কাঁচি, আঠা নিয়ে আমি ঝুঁকে থাকতাম ব্যগ্রমুখে। বইয়ের ওপর ফুটে ওঠা কোমল কল্পলতার নকশার ভেতর সুর বাজত যেন ঝমঝম...ঝমঝম---রঙের...জীবনের...ছন্দের। খুব মিষ্টি একটা নাম রেখেছিল দাদু সেসব মলাটের--- ‘পাখিগানের মলাট'।