মুক্তগদ্য : অমৃতা মুখার্জী

 







অমৃতা মুখার্জী


নিঃসঙ্গ ফুলকুমারী


১৯২৮ সালে কু ঝিক ঝিক করে লাল পাহাড়ী পথে ট্রেন টা চলেছিল আমেরিকার ওয়াইল্ড ওয়েস্ট এর দিকে। গ্রান্ড ক্যানিওন, কাউবয় আর রেড ইন্ডীয়ান দের আপন মুলুকের বুক চিরে। এ তোমার আজকের নড়বড়ে আমট্রাকের লাল নীল ট্রেন নয়কো। খানদানী পুরনো লোকোমোটিভ, জানলায় লেসের পর্দা, কাঠের পালিশ করা প্যানেল দেওয়া ডাইনিং কার, সার্ভার দের হাতে সাদা গ্লাভস। এর হুইসিল শুনলেই যত পুরনো বিরহ হু হু করে বুকের মধ্যে “ কেষ্টা বাজায় বাঁশি” বলে আকুলি বিকুলি করে উঠবে। পাঁচ নম্বর কামরার জানলায় তেমনি একটা মুখ। সে মুখে দুঃখ, না পাওয়া, হতাশার লম্বা লম্বা স্ট্রোক যেন টানা তুলির, হালকা হলুদ চোখের মণিতে ছলকে পড়া কলকে ফুলের বিষাদ। জর্জিয়া ওকিফী চলে যাচ্ছেন, সাধের নিউইয়রক ছেড়ে নিউ মেক্সিকো র দিকে, সান্টা ফে শহরের পানে। 

মন খারাপের আর দোষ কি ? মনের মানুষ যদি চোরের মত নিভৃত, ব্যক্তিগত মুহুর্তের নগ্ন ছবি তুলে প্রদর্শনী করে আর পিঠ ফেরানো মাত্র অন্য নারীতে আসক্ত হয়ে পড়ে ? ও বাবা! আর বলবেন না! এসব কাজে পুরুষ বাহিনী সেল ফোন যুগের অনেক আগেই দেখছি বেশ তৈরী ছেলে ছিল ? স্বভাব কি আর বদলায় ? টেস্টোস্টেরনের পুরনো কচকচি! ঘাটের মড়া স্টীগলিয বয়সে অনেক বড় ছিলেন জর্জিয়ার থেকে। তাতে আর কবে কি আটকেছে ? বয়স্ক পুরুষের কুমারীপ্রীতির অহরহ উদাহরণে ভরে আছে ইতিহাসের পাতা। এবারেও তাই হল। 

উইস্কন্সিনের বরফের উপত্যকায় মেষ পালকদের পরিবারে ১৮৮৭ সালে ফুটেছিল ফুল টি। নাম জর্জিয়া। ন ভাই বোনের মধ্যে পঞ্চম বোন। ছোট থেকেই তুখোড় ব্যক্তিত্ব আর বেগুনী ফুলের মাঠে গোলাপী সন্ধ্যায় একা একা ঘোরে খেপী মেয়ে, হাতে রঙ তুলি।  দশ বছর বয়স থেকে সোজা বলে দিয়েছিলেন তিনি চিত্রকর হবেন। 

বাবা ফ্রান্সিস আইরিশ, মা আইডা হাঙ্গেরিয়ান, মেয়ের স্বাধীনতায় হাত দেন নি। মেয়ে বেডিং বেঁধে বোর্ডিং স্কুলে চলে গেল সারা মানের কাছে আঁকা শিখবে। ওইটুকু মেয়ে কারো দিকে ফিরে চাইলে না। কি অসাধারণ স্থির প্রতিজ্ঞ বহ্নিশিখা। জীবনে কোন পরীক্ষায় দ্বিতীয় হন নি, সে ভার্জিনিয়ার স্কুল হোক কিম্বা টেক্সাসের কলেজ। সবেতে প্রথম, সবেতেই স্কলারশিপ। শিকাগোর আর্ট ইন্সটিঊটের ফেলোশিপ পেয়েছেন এমনকি টাইফয়েড  জ্বরে মরণাপন্ন হবার পরেও। পাশ করে নিউইয়রকে কাজ করতে এসেও ছবির কম্পিটিশনে একটা অদ্ভুত ছবি আঁকলেন "খরগোশ আর তামার টিন”। প্রশংসার বন্যায় ভেসে গেল। পুরস্কার পেলেন আর সেই টাকায় চলে গেলেন ক্যাম্প করতে। লেক জর্জ আপ স্টেট নিউইয়র্কের একটি নয়নাভিরাম স্থান। বন্ধুরা সবাই ছবি আঁকে হইহই করে ক্যাম্প ফায়ার হয়, জর্জিয়ার মন লাগে না। তিনি একা ঘুরে বেড়ান লেকের ধারে। 

দেখা হয়ে গেল রাহুর সাথে চাঁদের। বান্ধবী অনিতা আলাপ করিয়ে দিলেন বিখ্যাত ফোটোগ্রাফার আলফ্রেড স্টীগলিযের সাথে। বয়সে অনেকটাই বড়, কিন্তূ জহুরীর চোখ। হীরা চিনে নিল। ছবি তো নিল ই গ্যালারি তে দেখাবে বলে, জর্জিয়ার অসামান্য ঋজু দেহলতা আর রহস্যময় বাদামী হলুদ চোখের প্রেমে পড়লেন ফোটোগ্রাফার। মিলনের বাসন্তী রাত গুলো তে চতুর পুরুষ পেলব কাঁধ, সুললিত বাহু, আর দেহের অসমান উপত্যকা সহ যুগল হংসের ছবিগুলি অনবদ্য কুশলতায় লেন্স বন্দী করে ফেললেন।

 প্রেমে অবশ জর্জিয়া জানলেন না জীবন এক নিষ্ঠুর সার্কাসের দড়ি মাত্র। পা ফস্কালে উপহাস আর অপমানের ঝড় উঠবে গ্যালারিতে, আর সব কিছুই জোকারের হাতে সেলের ট্যাগ লাগিয়ে চক্কর দেবে পোষ মানা ঘোড়ার মিছিমিছি বন্যতায়। ছবিগুলি অসম্ভব জনপ্রিয় হল। যুগলের খ্যাতি তখন তুঙ্গে। এক্সিবিশনের টাকায় চলছে বাঁধন হারা ফুর্তি। একদিন জর্জিয়া বুঝলেন পাশার দান ঘুরে গেছে। আলফ্রেড স্টীগলিযের কোলে এসে গেছে নতুন প্রেমিকা। তিনি আর প্রেমযূথিকার মালিকা নন। 

মন টুকরো হয়ে ভাঙ্গলো। সম্পর্ক ফেটে চিরে ধারালো আয়নার মত পড়ে রইলো পায়ের কাছে। পা দিলেই রক্তাক্ত। জর্জিয়া হাসপাতালে ভর্তি হলেন। মানসিক বিষাদে একের পর এক সাইন করা ছবির কন্ট্রাক্ট ফিরিয়ে দিতে হল। ডিপ্রেশন ময়াল সাপের মত পেঁচিয়ে ধরেছে তখন তাকে, অস্তিত্ব বিপর্যস্ত। 

মুক্তি এল বন্ধুর হাত ধরে। চল বেড়িয়ে পড়ি সান্টা ফের দিকে, আকাশ যেখানে মরকত মণি নীল আর সমুদ্রের মত উদার। লাল মাটি মিশেছে দিগন্তের পানে, মাঝে পান্না সবুজ ছোট ছোট ঝোপ।

 ট্রেনে যেতে যেতে জানালা খুলে দিলেন জর্জিয়া। দামাল, সতেজ বাতাস হুমড়ী খেয়ে জড়িয়ে ধরল তার মুখ, বুক। প্রাণভরে শ্বাস নিলেন শিল্পী খোলা হাওয়ায়। আহা কি আনন্দ! এই তো আসল প্রেম! প্রকৃতির কাছেই তো আছে সেই অমৃত সুধা! তুচ্ছ, লম্পট পুরুষের কলুষিত স্মৃতি কে এক টানে উপড়ে ফেলে দিলেন তিনি আবর্জনায়। মর গে পচে ব্যভিচারের কুয়োতে। জীবন অনেক বড়।
সৃষ্টির খোলা মাঠে একলা দাঁড়াবেন তিনি হাতে তুলি নিয়ে। মাথার উপর ঈশ্বর আছেন সমুখে থাকবে জয়। 

নির্জন খামারে গিয়ে স্টুডিও খুললেন। সঙ্গে বান্ধবী রেবেকা। ওয়াগনে করে দু বন্ধু পাগলের মত ঘুরে বেড়ান। পাহাড়ে, বনে, গ্রান্ড ক্যানিওনের কন্দরে। জর্জিয়া পাগলের মত আঁকছেন। খাওয়া নেই, নাওয়া নেই , হাতে মুখে রঙ, চুলে জটের বাসা। গভীর লাল, হলুদ, সবুজ দিয়ে এঁকে ফেললেন আশ্চর্য সব ফুলের ছবি। যার গর্ভকেশরের দিকে তাকালে শরীর শিরশির করে ওঠে, যৌনতা আকঁতে গিয়ে নারীর বুক আর নিতম্ব ছাড়া যারা আর কিছুই ভাবতে পারেন না, জর্জিয়া একে একে তাদের বোকামীর কাদায় বসিয়ে দিলেন। গালে দিলেন অদৃশ্য চড়। 

তিনি কোন শস্তার চায়ের দোকান খুলবেন না। ওসব দিয়ে লোক ভুলিয়ে বিজ্ঞ চালাক আর্টিস্ট মোটেই সাজবেন না। তিনি জাত কেঊটের বাচ্চা। ওসব নকল খোলস তার লাগেনা। তিনি ফুল আঁকলেন, বুঝিয়ে দিলেন নারী কত সুন্দর তার গোপনে, শুধু শরীরে নয়, মনে, ভাবনায়, অনুভূতিতে। নারী কেমন ফুলের মত ফুটতে পারে, যন্ত্রণায়, ধৈর্য্যে, সহন শক্তি তে সে কেমন লিলির মত পরতে পরতে খুলে যায়, দুরন্ত পপি ফুলের মত লাল হয়ে সে কামনায় বিধুর হয়, গার্ডেনিয়ার সৌরভে কেমন সে মাতাল করে দেবে আপনাকে চন্দনের বনে। তার স্বাতন্ত্রে, স্বাধীনতায় সে অর্কিডের মত মাথা তুলে থাকবে, সমর্পণে গড়িয়ে পড়বে লতার লাবণ্যে। ক্ষুদ্র ব্যভিচারী, লালসা গ্রস্ত পুরুষের সাধ্য নয় তাকে বোঝা অথবা সম্মান করা। সবাই কি সব পারে ? জর্জিয়া পারলেন। শুধু সান্টা ফে নয়, পৃথিবীর মরুভূমিতে তিনি ফুল ফুটিয়ে দিলেন।

কোটি কোটি টাকায় বিক্রি হয়েছে তার ছবি। আজো হয়। আশি বছর বয়সেও একলা ঘুরতে চলে যেতেন মরুভূমিতে । একবার কুড়িয়ে পেলেন এক ষাঁড়ের খুলি। অদ্ভুত ভাবে আচ্ছন্ন হয়ে গেলেন। মৃত্যু কি সব কিছুর শেষ ? হতেই পারেনা। খুলি সঙ্গে ফিরে এলেন স্টুডিও তে। পাশে রাখলেন ছোট নীল ফুল । অসাধারণ ছবির জন্ম হল। নতুন সিরিজ শুরু করলেন। কি অদম্য কল্পনা, কি অসম্ভব সৃষ্টির রাগ বিস্তার। তিনি আপোস করেন নি কোন অশুভ শক্তির সাথে। এই নির্লজ্জ সমাজ তাকে উলঙ্গ করে খতম করে দিতে চেয়েছিল। তিনি একলা নারী। 

তার হাতে শুধু একটা তুলি ছিল। 

তিনি নিঃসঙ্গ ফুল কুমারী। 

তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন যুদ্ধ করতে বেশি কিছু লাগেনা। তার জয়ের রঙ আজো হোলি খেলে তার এঁকে যাওয়া দুরন্ত পপির লাল টুকটুক বুকে।