স্মরণলেখ : নিখিলকুমার সরকার

বৃহস্পতিবার, ১০ ফেব্রুয়ারী, ২০২২ /
ফেসবুক-এ শেয়ার করুন /
টুইটার-এ শেয়ার করুন

 





নিখিলকুমার সরকার


★ একটি যুগের অবসান...

       এই কালখণ্ডে বাংলাকবিতাচর্চার পথিকৃৎ প্রভাত চৌধুরী প্রয়াত হলেন। আকাশে বাতাসে দীর্ঘশ্বাসে উচ্চারিত , ' একটি যুগের অবসান হল ' । ঠিক কথা। তবে আমি এ-ও মনে করি , একটি রূপকথাসম নতুন যুগের সূত্রপাতও হল। এই নতুন যুগের স্রষ্টা প্রভাত চৌধুরী। তিনি বাংলাকবিতাচর্চার পথে রুদ্ধ তোরণদ্বার যত খুলে দিয়ে গেলেন। এই প্রজন্মের সকলের জন্য রেখে গেলেন আত্মসম্ভাবনার বিষ্ময়কর তথা মৌলিক সূত্রাবলি। এবং যাপনকথার বাইরে অনন্ত পরিসরের বাস্তবতা অন্বেষণের বহুমুখিন দিশা।
            পোস্টমডার্ন চিন্তা-চেতনার তাত্ত্বিক উন্মেষ ঘটেছিল বিদেশে। ঠিকই। প্রভাত চৌধুরী সেই তত্ত্ব বিনির্মাণ তথা মৌলিক রূপান্তর ঘটিয়ে আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্য-পরম্পরার সঙ্গে যুক্ত করলেন।  এমত অনন্য নান্দনিক কর্মকাণ্ডে তাঁর সঙ্গে ছিলেন সমীর রায়চৌধুরী (প্রয়াত) এবং রুদ্র কিংশুক -এর মতো প্রবীণ ও নবীন বিশিষ্ট কবি তথা চিন্তকগণ। তাঁদের রচিত সন্দর্ভে অধুনান্তিক ভাব-ভাবনার, চিন্তা-প্রকরণের বিচিত্র চিহ্নসমূহ ফুটে উঠতে লাগল। প্রভাত চৌধুরী তাঁর নিজস্ব লেখালিখি ও কবিতা সম্পৃক্ত কর্মকাণ্ডকে সংগঠিত রূপ দিতে প্রকাশ করলেন কবিতাপাক্ষিক। তিনি বাংলাকবিতাকে কলোনিয়াল হ্যাং-ওভার থেকে মুক্ত করতে প্রয়াসী হলেন। এবং একরৈখিকতায় আবদ্ধ আধুনিক কবিতাকে অতিক্রম করে বাংলাকবিতায় বহুরৈখিক-বহুমাত্রিক-বহুস্বরে সমবায়ী ব্যঞ্জনার রাইজোমাটিক কনসেপ্ট -এর প্রতিষ্ঠা দিয়ে গেলেন। কবিতার মূলধারা (মেইন স্ট্রিম) অস্বীকার করার যে প্রবণতা স্পষ্ট হয়ে উঠছিল, সেই প্রবণতায় তিনি  এক প্রবল গতিশক্তির সঞ্চার করেছিলেন। ফলত আধুনিক কবি ও কবিতার আধিপত্যবাদের বিমূর্ত প্রতীক ' মূলধারা ' প্রকৃতই নস্যাৎ হয়ে গেছে। তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ভেদ তথা বিয়োগচিহ্নগুলি মুছে যোগবন্দিশে যুক্ত হয়েছে   বাংলাকবিতার নিত্য-পরিসর। একসময় বিস্ময়াভিভূত সকলে অবলোকন করল যে , কবিতার নতুন মানচিত্র নির্মাণ তথা অধুনান্তিক কবিতাসৃষ্টির আনন্দে কবিতাপাক্ষিক -এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে চির-নতুনের অন্বেষক বাংলাভাষার নবীন কবি-মণ্ডলী। 
                *****
          রূপকথাসম নতুন যুগের কথা বলছিলাম। এই যুগের জাদুবাস্তব নিদর্শন তথা নতুন দর্শন -এর দৃশ্যরূপ মহাবৃক্ষ  কবিতাপাক্ষিক। চতুর্দিকে প্রান্ত অবধি বিস্তৃত তার শাখা-প্রশাখায়, পাতায় পাতায় , ফুলে-ফলে নতুন কবিতার রূপ-রস-গন্ধের সমারোহ। নিরবচ্ছিন্ন আত্ম-অন্বেষণ। বহুরূপে ধাবিত সেই অন্বেষায় অভূতপূর্ব সব অচেনা আলো ও অন্ধকারের প্রতিভাস। নিরন্তর কত না অজানা সত্যের উন্মোচন...। পরিধি থেকে উড়ে আসে প্রান্তিক পাখির ঝাঁক। তাদের ব্রাত্য-যাপনে সুপ্ত কবিতা এই বৃক্ষে ফুল হয়ে ফোটে। নানারঙের বিচিত্র সেসব ফুল। অদৃষ্টপূর্ব। চমকিত করে। মধুর সেই চমক। যার শেষ নেই। অশেষ চমকে সৃষ্ট অনাস্বাদিত শিহরন। শিহরন , নন্দনতত্ত্বের এক অনন্য ফলিত স্পন্দনে কথিত ঐতিহ্যের ছদ্মঘুম ভেঙে যায়...। বৃক্ষের সামগানে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে জড়জগৎ। সমূহ দরজা-জানালা , ভাঙা দেওয়াল, নিঃসঙ্গ মিনার অটোবায়োগ্রাফি লেখা শুরু করে। পাথর নিজেই ছেনির আঘাতে নিজেকে গড়ে তোলে স্বপ্নসম্ভূত ভাস্কর্য-প্রতিম। বিনির্মিত হয়। প্রদর্শনীর মায়াবী আলোয় নিজেকে ডিসপ্লে করার  স্পর্ধা দেখায়। অনিত্য যত সম্পর্ক -এর মাল্টিকালার ডাইমেনশন প্রতিনিয়ত পালটে যায়। এই অবজারভেশনের সূত্র ধরে বিনির্মিত হয় সমূহ পুরাতন, রচিত হয় সম্পর্ক -এর অধুনান্তিক টেক্সট। এমত সব সম্পর্ক ধারণ করে বৃক্ষ এখন এই সময়-এর মূর্ত-প্রতিমা এবং  ভবিষ্যতের দিশারি। বলাবাহুল্য , মহাবৃক্ষটির বীজ রোপণ করেছিলেন প্রভাত চৌধুরী এবং তিনি এই বৃক্ষেই লীন হয়েছেন। 
             *****
         নিজেকে জানা এবং অপরকে জানা --- পরস্পর পরিপূরক এক অভিন্ন জীবনচর্যা। নিজেকে জানার একমাত্র কৃৎকৌশল আপন হতে বাহির হয়ে 'অপর' সবার সঙ্গে মিলিত হওয়া, এবং এই প্রক্রিয়ার আন্তরিক প্রয়োগের মাধ্যমে জীবন ও জগৎ সম্পর্কিত সামগ্রিকতাবোধ গড়ে তোলা সম্ভব। সম্ভব নিজেকে সহজিয়া যোগাযোগ-সেতুরূপে গড়ে তোলা। প্রভাত চৌধুরী তাঁর  চৈতন্যবিভায়  প্রতিনিয়ত এই জীবনবোধ আমাদের কাছে স্পষ্ট করে দিয়েছেন। স্পষ্ট করেছেন তাঁর এই বাসনা --- কারও অনুসরণ, অনুকরণ নয়,  কবিতা যেন কবিরই স্বাক্ষর হয়ে ওঠে । আনন্দের কথা,ইতোমধ্যেই
১৮ থেকে ৮০ বয়সের  চিরনবীন উজ্জ্বল একঝাঁক শব্দস্থপতি জেনে  গেছে কীভাবে ক্রমাগত নিজেকে অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে হয়। এবং ক্লোজ-এন্ডেড সম্পর্ককে ওপেন-এন্ডেড সম্পর্ক-চেতনায় নতুন করে গড়ে তুলতে হয়। আর  এই পথেই অবয়বহীন প্রভাত চৌধুরী, প্রভাতদা চিরজীবী থেকে যাবেন, আগামি প্রজন্ম-পরম্পরা।

           ---*---