স্মরণলেখ : চন্দ্রদীপা সেনশর্মা

বৃহস্পতিবার, ১০ ফেব্রুয়ারী, ২০২২ /
ফেসবুক-এ শেয়ার করুন /
টুইটার-এ শেয়ার করুন

 







চন্দ্রদীপা সেনশর্মা


আমার মৃত্যুর পর শোক করবে না, গীতবিতান পড়বে'--প্রভাত চৌধুরী

তিনি এমন বহু কথা বলে গেছেন যা আশাবাদী। গত ফেব্রুয়ারি থেকে দীর্ঘ অসুস্থতায় তাঁকে বলতে
শুনিনি কোনো শারীরিক অসুবিধার কথা, বিরক্তির কথা। জীবন সম্পর্কে নিরাশার কথা। তিনি বাঁচতে
চেয়েছিলেন, জীবনকে আরও গভীরতায় হয়তো পেতে চেয়েছিলেন। তিনি বেঁচে আছেন। দেহের
মৃত্যু হলেও তাঁর ইচ্ছার প্রতিটি ভগ্নাংশ, যা তিনি আমাদের দিয়ে গিয়েছেন, তার মধ্যে অবশ্যই বেঁচে
আছেন, আমরা বিশ্বাস করতে চাই।

কবিতা পাক্ষিকের শুরু থেকে, অর্থাৎ ৯৩/৯৪ সাল থেকে তাঁকে দেখেছি, পড়েছি তাঁর লেখা। তবে
আলাপ বলতে বাবার মৃত্যুর পর ২০০৭ সালে যখন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাই। তিনি পটলডাঙায়
ডেকেছিলেন, কিন্তু যাওয়া হয়নি। বাবার মৃত্যুর পর গভীর অবসাদে লেখা ছেড়ে দিই। কিন্তু পটলডাঙ্গা
না গিয়ে আমার যে ক্ষতি হয়েছিল তা বুঝতে দীর্ঘ বারোবছর সময় পেরিয়ে গেল। ২০১৯ বইমেলায়
প্রভাত চৌধুরীর সঙ্গে আবারও সাক্ষাতের পর। প্রায় তিনবছর তাঁর সঙ্গ পেয়েছি। লেখক বা কবি
হয়ে উঠেছে কি না, জানি না, কিন্তু বাবার শূন্যস্থান তাঁর স্নেহে শুধু ভরে ওঠেনি, অবসাদ সম্পূর্ণ দূর
হয়ে গেছে। বুঝেছি ২০০৭ সালের পর খুব জরুরি ছিল পটলডাঙা যাওয়া।

তিনি ঘুরতে ভালোবাসতেন, বিশেষ করে পাহাড়ে। তিনি বলতেন, ১০,০০০ ফিটের নীচে ঘুরে এলে
পাহাড়ে ঘোরা হয় না। জীবনকে তিনি এই উচ্চতা থেকেই দেখেছেন। ঝরঝরে গদ্যে ভ্রমণকাহিনী
লিখেছেন। যেভাবে লিখেছেন 'সতী সাবিত্রী কথা' বা 'অনুপম কাহিনী'র মতো উপন্যাস। সমালোচনা
করে বলতেন 'সতী সাবিত্রী' ট্র্যাশ লেখা। 'অনুপম কাহিনী' কেউ বোঝে না। অনুপম কাহিনী পড়তে
পড়তে মনে হয়েছে গদ্যলেখক প্রভাত চৌধুরীকে কি কবি প্রভাত চৌধুরী দমিয়ে রাখলেন? বইটিকে
তিনি পোস্টমর্ডান টেক্সট বললেও, কত সহজে জীবনযাপনের সত্যকে, দর্শনকে এই লেখায় তিনি
তুলে ধরেছেন। দর্শন লিখতে তিনি বারণ করতেন। সেই তিনিই এই পোস্টমর্ডান টেক্সটে একজন
দার্শনিককে ঢুকিয়ে দিতে পেরেছেন। তাঁর কবিতার বই 'সাক্ষাৎকার'এর মতো এটিও আমাদের অত্যন্ত
প্রিয়, আমরা যাঁরা পড়েছি।

তাঁর প্রয়াণ আমার কাছে দ্বিতীয়বার পিতৃবিয়োগের মতো হলেও এবার কোনো শোক নেই। তাঁর কথার
আবহে ডুবে আছি। তাঁর সঙ্গে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত, কলকাতা বর্ধমান কাটোয়া বইমেলা হোক,
বা পটলডাঙার বাসা কিংবা রুফটপ হোক, আনন্দ শুধু আনন্দ পেয়েছি। তাঁর হাত শুধু কলমের দক্ষ
ধারক নয়, রান্না এবং বাগান পরিচর্যায় একইরকম কুশলী। কবিতা ছাড়াও এ সব নিয়ে কত গল্প তিনি
শুনিয়েছেন। ছানার ডানলা পাবদার কালোজিরে ঝোল কী অনায়াসে কবিতার পাশাপাশি তিনি বলে
যেতেন। কাটোয়ার 'জলপরোটা', তাঁর দেওয়া নাম, আমাদের একত্রে ব্রেকফাস্ট, ভুলি কী করে।

ফুটবল টেনিস ক্রিকেট আলোচনা, সেও আছে। তিনি বলতেন ফুটবল নব্বই মিনিটের খেলা, গড়ে
পায়ে চার মিনিটের একটু বেশি হয়তো বল থাকে এক একজন ফুটবলারের। অর্থাৎ অফ্ দ্য বল
খেলাই কিন্তু আজকের ফুটবল। অথচ এই খেলায় আমরা এখনও তেমন কুশলী হয়ে উঠতে পারিনি।
১৪০০ সাল ওয়েবজিনে নাদালের উপর লিখলাম। খুশি হলেন। 'তুমি বেশ লেখ তো, খেলাই লেখ,
কবিতা তোমার দ্বারা হবে না'। কত বকা খেয়েছি, শিখেছি অনেক বেশি। তাঁর কথামতো কবিতাকে
কতদূর 'আপডেট' করতে পেরেছি জানি না, কিন্তু প্রতিমুহূর্তে প্রয়াসী হয়েছি অন্যরকম লিখতে।

১৪০০ সাল সম্মাননা পাচ্ছেন, জানিয়েছিলাম, কিন্তু আপশোশ হাতে তুলে দিতে পারলাম না। এই
দুঃখ আমার আজীবনের। তিনি প্রণাম নিতেন না, বলতেন বুড়োকে(রবীন্দ্রনাথ) করো। আমি দুবার
তাঁকে প্রণাম করতে পেরেছি ভুলিয়েভালিয়ে, তাঁর মধ্যে একজন বাচ্চা ছিল, সেই কবিতা আপডেট
করত, ওই বাচ্চাকে ভোলানো যায় ভালোবাসলে।

ভালোবাসা কাকু। ভালোবাসা প্রভাত চৌধুরী নামের কবিতার ম্যাজিশিয়নকে।