বাণীব্রত চক্রবর্তী
ধারাবাহিক উপন্যাস
কালতরঙ্গ
ছয়
রবিবার সকল এগারোটার আগে কিঞ্জল কফি হাউসে আসত না। ইদানীং আর সকালে যায় না। বিকেলে যায়। রবিবার মোটামুটি কফি হাউস ফাঁকা থাকে।
কিঞ্জলের বাড়িতে ফোন করা মুশকিল। মীরা একবার করেছিল। এক ভদ্রলোক ফোন ধরেছিলেন। তাঁর কণ্ঠস্বর গম্ভীর। তিনি প্রথমেই জিজ্ঞেস করেছিলেন , " কে আপনি! " মীরা বলেছিল, " আমি কিঞ্জলের বন্ধু।" উনি কিঞ্জলকে ডেকে দিয়ে ছিলেন। চটপট দু'একটা কথা বলে কিঞ্জল ফোন রেখে দিয়েছিল। পরে মীরাকে বলেছিল , " ওভারে আমাকে বাড়িতে ফোন করিস না। " মীরা তো অবাক, " ওভারে মানে! তাহলে কীভাবে তোকে ফোন করব! " কিঞ্জল বুঝতে পারল মীরাকে ঠিক যা বলতে চেয়েছিল তা না বলে অন্যকথা বলেছে। যা বলতে চেয়েছিল এবার সেটা বলল, " আমাকে ফোন করিস না। আমাদের বাড়ির ভেতরের বারান্দায় ফোনটা একটা ছোট টেবিলে থাকে। তার পাশেই একটা চেয়ার। ওই চেয়ারে জেঠু বসে থাকেন। কোনও ফোন এলেই প্রথমে জেঠু ফোনটা ধরেন। " মীরা এবারেও অবাক, " চব্বিশ ঘন্টাই কি তোর জেঠু ফোনের পাশে বসে থাকেন! " এবার কিঞ্জল হেসে ফেলল, " না। না। তা কেন! কখনও নিজের ঘরে থাকেন, কখনও একতলায় বা ছাদে। কিন্তু ঝনঝন করে ফোন বাজলে যেখানেই থাকুন না কেন তড়িঘড়ি করে এসে ফোন ধরেন। বাড়ির সবাই জানে ফোন বাজলেই জেঠু যদি ফোনের কাছাকাছি না থাকেন তক্ষুনি তাঁকে খবর দিতে হবে। " মীরার বিস্ময়ের মাত্রা বেড়ে যায় , " অদ্ভুত তো! " কিঞ্জল বলে, "হ্যাঁ। বাইরের মানুষের কাছে উনি অদ্ভুত। তবে আমাদের বাড়ির মানুষদের কাছে নয়। " মীরার কৌতূহল বেড়েই যাচ্ছে , " তোদের কাছে নয় কেন! "
এসব কথাবার্তা হচ্ছিল কফি হাউসে বসে। ওরা যে যার কলেজ থেকে বেরিয়ে কফি হাউসে এসে বসেছিল। পাশের দেওয়ালে রবীন্দ্রনাথের সেই বিশাল ছবি। পরপর কয়েকটা ক্লাস অফ। মীরার বাংলা অনার্স ক্লাস। কিঞ্জলের ইংরেজি অনার্স ক্লাস। দুজনেরই একই সময়ে ক্লাসের টানা অফ। কিন্তু দুজনের কলেজ এক নয়। মীরা বেথুনে পড়ে। কিঞ্জল প্রেসিডেন্সিতে।
ক্লাস টানা অফ বলে বেথুন থেকে বেরিয়ে ট্রামে চেপে মীরা চলে এসেছিল কলেজ স্ট্রিটে। পরস্পরের রুটিন মুখস্থ। মীরা জানত এখন কফি হাউসে গেলে কিঞ্জলকে পাওয়া যাবে।
ঠিক যা ভেবেছিল তাই। রবীন্দ্রনাথের প্রকাণ্ড ছবিটার কাছে কিঞ্জল একা বসে আছে। মুখে সিগারেট। চারমিনার। ডি.এইচ.লরেন্সের সানস্ অ্যান্ড লাভার্স বইটা পড়ছে। ওদের অনার্সের পাঠ্যবই ওটা।
মীরা পুরনো প্রশ্নে ফিরে এল, " জেঠুর ব্যাপারটা তোদের কাছে অদ্ভুত নয় কেন! " কিঞ্জল বলেছিল , " বলছি। "
ততক্ষণে সাদা উর্দিধারী কফি হাউসের বেয়ারা ফারুক এসে গেছে। টেবিলের ওপর একে একে নামাচ্ছে দুকাপ ইনফিউশন, একপ্লেট চিকেন স্যান্ডউইচ, দু গ্লাস জল। কাচের গ্লাসের ভেতর পরিষ্কার জল যেন খিলখিল করে হাসছে। ওরা কালো কফিতে চুমুক দেয়। এবার কিঞ্জল মুখ তোলে, " জেঠু টেলিফোনে চাকরি করতেন। তাঁর সহকর্মিণী ছিলেন তৃষ্ণা। আস্তে আস্তে দুজনে পরস্পরের প্রেমে পড়ে যান। দু' একবার তৃষ্ণা আমাদের বাড়িতেও এসেছেন। তখন অবশ্য আমার জন্ম হয়নি।" কিঞ্জল থামে। হাত বাড়িয়ে একটা স্যান্ডউইচ নেয়। মীরা অস্থির, " তারপর! " খেতে খেতে কিঞ্জল বলে, " দাঁড়া। খেয়ে নিয়ে বলছি।"
কোন মন্তব্য নেই
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন