বাণীব্রত চক্রবর্তী
ধারাবাহিক উপন্যাস
কালতরঙ্গ
এগারো
এবার মীরার দিকে তাকিয়ে ছবিরানি জিজ্ঞেস করলেন, " ইন্দিরা কেমন আছে ? " আড়চোখে কিঞ্জলের দিকে তাকালেন। ছেলেটা আস্তে আস্তে লজ্জা -ভয় কাটিয়ে একটু একটু করে স্বাভাবিক হচ্ছে। মীরার ও সবের বালাই নেই। বরাবরই বোধহয় মেয়েটা এমন সপ্রতিভ।
মীরা বলল, " বাতের ব্যথায় খুব কষ্ট পাচ্ছেন। দিদা একরকম বাড়িতে বন্দি। নতুন দিদা, তুমি কিন্তু এখনও বেশ ফিট আছ। তুমি কি যোগব্যায়াম টায়াম করো ! " হো হো করে হেসে ওঠেন ছবিরানি, " কী যে বলো! সংসার সামলাতেই হিমশিম। ওসব করব কখন ! আসলে আমার গড়নটাই এইরকম।। "
মীরা ভাবছিল নতুন দিদাকে সে আপনি না তুমি বলত সেটা মনে পড়ছে না। তুমি বলাই ঠিক। তাতে ওঁকে আরও আপন মনে হবে।
বলল, " হ্যাঁ। আপনাকে কিন্তু অনেকটা ওয়াহিদা রহমানের মতো দেখতে। " ছবিরানি হাসতে হাসতে বললেন, " তা.... ই ! আজকাল এই এক চেহারার মাপকাঠি হয়েছে। সিনেমার নায়ক -নায়িকার চেহারার সঙ্গে তুলনা করার আগ্রহ। তুমি খুব সিনেমা দ্যাখো বুঝি ! কার সঙ্গে সিনেমায় যাও ! কিঞ্জলের সঙ্গে ?" কিঞ্জলের মুখ আবার লজ্জারুণ হয়ে উঠছে। কিঞ্জল বলল, " না। না। আমি কেন যাব !মীরার কত বান্ধবী। তাদের সঙ্গে যায়। " মীরা ফোঁস করে উঠল, " মিথ্যে কথা বলছিস কেন ! সেদিন তোর সঙ্গে ওরিয়েন্টে বাসু ভট্টাচার্যের তিসরি কসম দেখে এলাম তো ! " কিঞ্জল কোনও উত্তর দিল না। ছবিরানি বললেন, " বেশ।বেশ। এতে লজ্জা বা ঝগড়া করার মতো কিছু তো নেই। বন্ধু কি বন্ধুর সঙ্গে সিনেমা দেখতে যেতে পারে না ?"
মীরা বলল, " আপনার বন্ধু ইন্দিরা কিন্তু উত্তমকুমারের বড় ফ্যান।ছবিরানি জিজ্ঞেস করলেন, " তুমি কার ফ্যান ! কেবল হিন্দি ছবিই দ্যাখো? "
মীরা মাথা নাড়ল, " তা কেন ! সব ছবিই দেখি। হিন্দি, বাংলা, এমনকি হলিউডের ছবিও। আপনি রোমান হলি ডে দেখেননি ! সেই মুভি দেখে আমি আর কিঞ্জল গ্রেগরিপেক আর অড্রে হেপবার্নের ফ্যান হয়ে গেছি। গ্লোব সিনেমা হাউসে ওই মুভি দেখেছিলাম।" কিঞ্জল সায় দিল. " হ্যাঁ। বেশ ভালো ছবি।"
কিন্তু মীরা নিজের আচরণের জন্য নিজের কাছে নিজেই চমকাল। নতুন দিদার সঙ্গে কথা শুরু করেছিল তুমি সম্বোধনে। তারপর আবার আপনি -আজ্ঞে করছে কেন !
কিঞ্জল খানিকক্ষণ চুপ করে বসেছিল। এবার বলল, " আপনি নাকি খুব গল্প - উপন্যাস পড়েন ! আপনার প্রিয় লেখক নাকি নরেন্দ্রনাথ মিত্র ! "
ছবিরানি অবাক, " এসব কথা তোমাকে কে বলল ! " কিঞ্জল বলল, " মীরার মুখে শুনেছি। " মীরা মুচকি মুচকি হাসছে। কিঞ্জল আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। বলল, " বাংলা বই আমার বেশি পড়া হয় না। তবে ওঁর চেনা মহল উপন্যাসটা পড়েছি। ভালো লেগেছে।" সে থামল। ছবিরানি মন দিয়ে তার কথা শুনছে বুঝতে পেরে সোৎসাহে বলল, " আমার ডি. এইচ. লরেন্স , কাফকা, টমাস মানের লেখা খুব ভালো লাগে। " ছবিরানি বললেন, " লরেন্স না হয় বুঝলাম। কাফকা আর টমাস মানের লেখা নিশ্চয়ই ইংরেজি তরজমা পড়েছ। আমিও কিছু কিছু পড়েছি । " কিঞ্জল হতবাক। ইনি তো দেখছি রীতিমতো এনলাইটেড ! মীরা আবার মুচকি মুচকি হাসছে। ছবিরানি একটু হেসে বললেন, " যা ভাবছ তা কিন্তু নয়। বেথুন বা ডায়োসেশনে পড়িনি। আমার দৌড় ম্যাট্রিক পর্যন্ত। পড়তাম ব্রাহ্ম গার্লস স্কুলে। তারপর তো বিয়ে হয়ে গেল। চলে এলাম এই তালতলার শ্বশুরবাড়িতে। এখানে এসে নতুন ঠাকুর পো-র কাছে নবপর্যায়ে হাতে খড়ি হল। উনি আমাকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে পারদর্শিনী করে তুললেন। স্কুলে ইংরেজি ও বাংলায় ভালো মার্কস পেতাম। তবে একশোতে একশো নয়। লিটারেচারে তো তা পাওয়া যায় না। ম্যাট্রিকেও সে ধারা বজায় ছিল। "
নতুন দিদা ইংরেজি ও বাংলায় তুখোড় মীরা জানত। তার মা-দিদিমার কাছে শুনেছিল। কিন্তু এ কথাটা কিঞ্জলকে বলা হয়নি।
ছবিরানি উঠলেন, " তোমরা বোসো। দেখি ওদিকে চা- জলখাবারের কতদূর হল। নতুন ঠাকুর পোকেও ডেকে দিচ্ছি। তোমাদের প্রস্তাবটাও ওঁর কাছে পেশ কোরো। মনে হয় না আপত্তি করবেন। "
ছবিরানি বৈঠকখানা থেকে বেরিয়ে বাড়ির ভেতর চলে গেলেন।
এবার কিঞ্জল মীরার দিকে তাকাল, " আচ্ছা বোকা বানালি তো ! নিশ্চয়ই জানতিস উনি ইংরেজি ভালো জানেন ! কই, আমাকে বলিসনি তো ! "
মীরা কোনও জবাব দিল না। কেবল হি হি করে হেসে উঠল।
কোন মন্তব্য নেই
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন