হম রহে ইয়া না রহে কাল... KK




 



হম রহে ইয়া না রহে কাল...

বয়সে ছোট কোনও ব্যক্তির স্মরণলেখ লিখতে হবে ভাবিনি। কেকে অর্থাৎ কৃষ্ণকুমার কুন্নথ মাত্র
৫৩ বছরে কলকাতার নজরুল মঞ্চে অনুষ্ঠানের পর ৩১ মে ২০২২ কার্ডিয়াক অ্যরেস্টে চলে গেলেন। এ মৃত্যু বড়ো বেদনার, যদিও আমরা বিশ্বাস করি প্রকৃত শিল্পীর মৃত্যু হয় না।

আমি কোনও সংগীত বিশেষজ্ঞ না। ছোট থেকে হিন্দুস্থানি ধ্রুপদি সংগীত সামান্য শিখলেও
কেকে'র প্রতিভা নিয়ে আলোচনা করার জন্য তা বিশেষ কাজে আসবে না। বরং সংগীত অনুরাগী
হিসাবে দু'চার কথা বলতে চেষ্টা করছি। ওঁর প্রথম অ্যালবাম 'পল' নয়ের দশকে শ্রোতাদের সামনে
আসে। এবং মুহূর্তে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে যায়। মেহবুবের লেখা লেসলি লুই'এর সুরে 'হম রহে ইয়া
না রহে কাল' এবং 'ইয়ারোঁ দোস্তি বড়ী হি হাসিন হ্যায়' এই দুটো গান স্কুল-কলেজ অনুষ্ঠানের অ্যান্থেম হয়ে যায়। এবং তা তিনদশক পরে আজও একইরকম জনপ্রিয়।

কোনও গায়ক বা গায়িকা মিউজ়িক কম্পোজ়ারের স্বপ্ন হতেই পারেন। কেকে বোধহয় সুরকার এবং
গীতিকার উভয়েরই স্বপ্ন। টোনাল কোয়ালিটির ব্যবহারে আর্তিতে তিনি প্রতিটি শব্দ বাক্যকে
যেভাবে অর্থবহ করে তুলতেন, তা ইদানীং সময় ছেড়েই দিলাম, পুরোনো সময়েও খুব কম গায়ক
গায়িকাই পেরেছেন। এইজন্য নিজের লিরিক কেকে'র কণ্ঠে রেকর্ডিং তন্ময় হয়ে শোনেন স্বয়ং
গুলজ়ার! হিন্দি সিনেমায় মূলত কবিরা গান লেখেন। অধিকাংশ লেখা কবিতা হয়ে ওঠে।
দু'একজন বিখ্যাত কবি যদিও গান ও কবিতার মধ্যে সীমারেখা রেখেছেন কখনও স্বেচ্ছায় কখনও
ফিল্মের সিচুয়েশন মেনে। কারণ কবিতা কবির নিজস্ব, কিন্তু ফিল্মে সিচুয়েশন মেনে সুর বুঝে
তাঁকে তাঁর ভাবনা ভাবতে হয় বদলাতে হয়। কেকে অসামান্য সেই গায়ক যিনি প্রতিটি গানে পোয়েটিক
জাস্টিস দিয়ে গেছেন প্রখর মিউজ়িক বোধ দিয়ে। গানের সঙ্গে তাঁর কানেকশন বা সংযোগ ছিল
একশো শতাংশ অনুভবের।

গুলজ়ারের লেখা 'ছোড় আয়ে হম ও গলিয়াঁ' গানে হরিহরণ এবং সুরেশ ওয়ড়করের মতো দুজন
লিজেন্ড থাকা সত্ত্বেও শুরুর দু'লাইন, উঁচুসুর যেখানে তীব্রতায় আছড়ে পড়ছে, বিশাল ভরদ্বাজ
কেকে'কে দিয়েই গাইয়েছেন। অন্বিতা দত্তগুপ্তের লেখা 'খুদা জানে' গানে শিল্পা রাও ডুয়েটে
থাকলেও 'খুদা জানে ম্যায় ফিদা হুঁ... বন গয়ে হো তুম মেরে খুদা' এই অংশ পাঁচবারই কেকে
গেয়েছেন। বিশাল-শেখর বুঝেছিলেন, হাই পিচে অনুভব নিংড়ে দিতে একমাত্র কেকে পারেন।
উপরের নোটেশনে অনুভব ধরে রাখতে কেকে অনন্য একথা এ আর রহমানও বলতেন।

'আওয়ারাপন বনজারাপন' (লেখা: নীলেশ মিশ্র, সৈয়দ ক়াদরি)  এবং 'ম‍্যায়নে দিল সে কহা, ঢুঁড
লানা খুশি/নাসমঝ লায়া গ়ম, তো ইয়ে গ়ম হি সহি' (লেখা:নীলেশ মিশ্র) দুটি গানে এম এম
ক্রিমের সুরে খাদে কেকে'র কণ্ঠমাধুর্য আমাদের মুগ্ধ করে। মন্দ্র মধ্য তার তিন সপ্তকে কেকে
ছিলেন অনায়াস এবং একইরকম সাবলীল। লবোঁ কো লবোঁ পে' গানে অন্তরায় যেখানে 'বাঁহোঁ মেঁ'
শব্দটি বারবার আছে, কেকে'র কণ্ঠস্বরের ব্যবহার অসামান্য। তাঁর মখমলের মতো কণ্ঠস্বরকে তিনি
অনুপম দক্ষতায় ব্যবহার করেছেন প্রতিটি গানে। শব্দ হয়ে উঠেছে প্রাণবন্ত, লিরিক হয়ে গেছে
নিখাদ কবিতা।

ভারতীয় ধ্রুপদি সংগীত না শেখার কারণে ধ্রুপদি সংগীতের কড়া অনুশীলনে তিনি গান গাইতেন না,
অতিরিক্ত কাজ এবং দক্ষতা প্রমাণের কোনো চেষ্টাও তিনি করেননি। রক সংগীত শোনার কারণে
তাঁর ভয়েস থ্রো ছিল রকস্টারের মতো। শুনেছি Led Zeppelin রক ব্যান্ডের কেকে খুব ভক্ত
ছিলেন। রক, মেটাল শোনার অভিজ্ঞতা তাঁর গাওয়া বিরহের গানে বেদনা এবং ক্ষোভের অপূর্ব
সংমিশ্রণ ঘটিয়েছিল। 'তড়প তড়প কে ইস দিল সে' গানে, ইসমাইল দরবারের সুরে এই আর্তনাদের
মতো বেদনা যেন সরাসরি বুকে এসে বিঁধে যায় শ্রোতাদের। শুধু গান নয়, শ্রোতাদের সঙ্গে তাঁর
সংযোগও অসামান্য।

সৈয়দ ক়াদরির লেখা দিল ইবাদত, বীতে লমহেঁ, সুর প্রীতম এবং মিঠুন; সন্দীপ শ্রীবাস্তবের লেখা
'ও মেরী জান', অমিতাভ ভট্টাচার্যের লেখা 'কাল কী হি বাত হ্যায়/ বাহোঁ মেঁ পহলিবার আয়া হ্যায় তু'
'অলবিদা' লেখক অমিতাভ ভার্মা, সুর প্রীতম;  ''আঁখোঁ মে তেরী অজব সী অজব সী আদায়েঁ হ্যায়'
লেখা জভেদ অখ্তার, সুর বিশাল দদলানি; 'তু আশিকী হ্যায়' সুর বিশাল-শেখর, লেখা বিশাল
দাদলানি; 'সচ কহে রহা হ্যায় দিবানা' সুর আদেশ শ্রীবাস্তব, হ্যারিস জয়রাজ, লেখা সমীর; 'অভি
অভি তো মিলে হো' শ্রেয়া ঘোষাল ডুয়েটে, সুর  অর্কপ্রভ মুখার্জি, লেখা অর্কপ্রভ, মনীশ মাখিজা;
এরকম অসংখ্য গান শুনলে বোঝা যায়, কেকে'র গান শোনা এক দুর্লভ অভিজ্ঞতা।

রোমান্টিক পেপি স্যাড সব গানে কেকে ছিলেন অনবদ্য। তিনি যুব প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব করে
গেছেন তিনদশক ধরে। তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল ফ্রেশ। আজকের অশান্ত গতিময় প্রজন্মের জন্য তা
একধরনের নিরাময় বা শান্তি। তাই তাঁর কনসার্ট দেখতে উপচে পড়ত ভিড়। তাঁর গানে আমাদের
হৃদয়ে তিনি বেঁচে থাকুন।
-----------

পুনশ্চ: কেকে কখনও কোনও বিতর্কে থাকেননি। পূর্বসূরি কুমার শানু অভিজিৎ, সমকালীন শান
সোনু নিগম শ্রেয়া ঘোষাল পলাশ সেন, উত্তরসূরি অরিজিৎ আরমান জুবিন নটিয়াল এবং উপরে
উল্লিখিত সুরকার ও গীতিকার প্রত্যেকে তাঁকে তাঁর সময়ের অন্যতম গায়ক হিসাবে মনে করেছেন।
তাঁকে নিয়ে অমার্জিত ভঙ্গিমায় আমাদের বাংলার শিল্পীর বলা কথা অত্যন্ত অনভিপ্রেত। তাঁর মৃত্যুর
একদিন আগে বলেছেন বলে নয়, তাঁর মৃত্যু না হলেও বক্তব্য সমর্থনযোগ্য না।