Call of the Valley : পণ্ডিত শিবকুমার শর্মা

 





  Call of the Valley
পণ্ডিত শিবকুমার শর্মা


আমাদের বাড়িতে অলিখিত নিয়ম ছিল একমাত্র ভারতীয় ধ্রুপদি সংগীত রেকর্ড কিনে শোনা এবং
ধ্রুপদি সংগীতের অনুষ্ঠানে যাওয়া। কোনও চাপ না দিয়েও বাবা মানিয়ে নিতে পেরেছিলেন আমাকে।
এ অভ্যাস আমার বরাবরের হয়ে গেল। অন্য গান বা বাজনা রেডিয়ো বা আত্মীয়-বন্ধুর বাড়ি।

একসময় রেকর্ডপ্লেয়ার রেকর্ড অচল হয়ে গেল। টেপরেকর্ডারের যুগ এল। আমার মাধ্যমিক পাশের
পর বাবা একটি টেপরেকর্ডার উপহার দিলেন। ক্যাসেট শোনার সেই শুরু। কিন্তু পণ্ডিত শিবকুমার
শর্মা'র সন্তুরবাদন আমি লাইভ শুনেছি আগে, ক্যাসেটে পরে। সেতার সরোদ বেহালা শোনার
কান ছোট থেকে তৈরি হলেও সন্তুর শিবকুমার শর্মাজী'র লাইভ কনসার্টে প্রথম শুনি একটু বড়ো
হয়ে। বোধহয় এগারো-বারো শ্রেণিতে তখন। প্রথম লাইভ শো-এ মনে হল উনি কি সন্তুর বাজাচ্ছেন না
গভীর ধ্যানে ডুবে গেছেন? ধ্রুপদি অনুষ্ঠানে প্রায় প্রতি শিল্পী ধ্যানস্থ হয়ে পড়েন কিন্তু আমার
চিরকাল বিসমিল্লাহ্ খান, নিখিল ব্যানার্জি এবং শিবকুমার শর্মা এঁদের একটু বেশি ধ্যানমগ্ন মনে হতো, কেন বলতে পারব না, হয়তো সম্পূর্ণ নিজস্ব ধারণা। আর শিবকুমারজী'র চেহারা তো ঋষিতুল্য অবশ্যই।

খুব অল্প বয়সে বাবা উমা দত্ত্ শর্মার কাছে কণ্ঠ এবং তবলার তালিম নিতে শুরু করেন শিবকুমার
শর্মা। একটু বড়ো হলে বাবা তাঁকে জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ ইনস্ট্রুমেন্ট সন্তুরে তালিম দিতে শুরু করেন।সন্তুর মূলত একটি পার্শিয়ান ইনস্ট্রুমেন্ট। কিন্তু বাজনাটি প্রভূত জনপ্রিয় হয় জম্মু-কাশ্মীরে। সুফি সুর এবং পাহাড়ি লোকসংগীতের সুর মিলেমিশে সন্তুর একদম অন্যধরনের একটি বাদ্যযন্ত্র। সুরেলা মিঠে পাহাড়ি ঝরনার মতো খিলখিল করে যেন সুর ঝরে পড়ে। বাবার সহযোগী শিল্পী হিসাবে
পণ্ডিত শিবকুমার শর্মা স্টেজ পারফরমেন্স শুরু করেন। তিনি কিন্তু তবলাও বাজাতেন এবং সংগত
করতেন। সন্তুর বাদ্যযন্ত্রটি নিয়ে তাঁর নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা একে ধ্রুপদি অন্য বাদ্যযন্ত্রের
সমতুল করে তোলে। সুরের দীর্ঘস্থায়ী অনুরণন মিড় তিনিই সন্তুরে নিয়ে আসেন। তিনি প্রতিটি
ধ্রুপদি আসরে সন্তুর বাজাতে শুরু করেন। তাঁর এই অবদান একমাত্র উস্তাদ বিসমিল্লাহ্ খানের
সঙ্গে তুলনীয়। উস্তাদজীর কারণেই  বিয়ের নহবত থেকে ধ্রুপদি সংগীতের আসরে অন্যতম শ্রেষ্ঠ
বাদ্যযন্ত্র হয়ে উঠতে পেরেছিল সানাই। সন্তুরও পণ্ডিত শিবকুমার শর্মার জন্য সেতার সরোদ
বেহালা প্রভৃতির সঙ্গে শ্রোতাদের কাছে হয়ে উঠতে পেরেছে আদরণীয়।

আমি যত ধ্রুপদি গায়ক বাদকের লাইভ অনুষ্ঠান দেখেছি, সবথেকে বেশি দেখেছি শুনেছি পণ্ডিত
শিবকুমার শর্মাকে। এ আমার সৌভাগ্য। বোধহয় অন্তত দশবার। মঞ্চে বাদ্যযন্ত্রশিল্পী নৃত্যশিল্পী এবং
কণ্ঠসংগীতশিল্পীদের সঙ্গে বহু সময় সংগতকারী তবলিয়ার একটা টানাপড়েন চলে। বিশেষ করে
তবলা শিল্পী যদি খুব জনপ্রিয় হন। সাধারণত এমন হয় মূল শিল্পীর থেকে তিনি বেশি বাজিয়ে চলেছেন
বা তাঁর ভক্তদের 'আরও আরও' দাবি অনুষ্ঠানের আমেজ নষ্ট করে দিচ্ছে। পারকাশন বা রিদম'এর
মধ্যে যে উন্মাদনা থাকে, ভক্তরা কম-বেশি উচ্ছ্বল হয়েই পড়েন। এও দেখা গেছে মূল শিল্পী সংগতে
যিনি আছেন তাঁকে যথার্থ সম্মান বা স্পেস দিচ্ছেন না। শিবকুমার শর্মা নিজে তবলিয়া বলে বোধহয়
তাঁর সন্তুরবাদনের সংগতে থাকা তবলিয়াকে তিনি ঠিক সময়মতো স্পেস দিতে জানতেন। সম্মানিত
তবলিয়া বুঝে যেতেন কখন থেমে যাবেন। এ কথা আমার না, উস্তাদ জ়াকির হুসেন কোনও একটি
সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন। মনে রাখতে হবে জনপ্রিয়তম তবলিয়া জ়াকির হুসেন শিবকুমার
শর্মার সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সবথেকে বেশি তবলা বাজিয়েছেন। দুজনের বোঝাপড়া ছিল অতুলনীয়।

পণ্ডিতজী'র সন্তুরবাদন নিয়ে কোনও মতামত জানানোর যোগ্যতা আমার নেই। রাতের পর রাত,
ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে গেছে তাঁর সন্তুর শুনে শুনে। শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছি। এই অভ্যাস আজও আছে। এমনকী তাঁর দেওয়া ফিল্মি গানের সুর তাঁর সুযোগ্য পুত্র রাহুল শর্মার সন্তুরের সঙ্গে Richard Clayderman(পিয়ানো) Kenny G(স্যাক্সোফোন), G(স্যাক্সোফোন), এঁরা যখন বাজান সেও এক শ্রুতিমধুর অভিজ্ঞতা।


ভি শান্তরামের 'ঝনক ঝনক পায়েল বাজে' ফিল্মে গোপীকৃষ্ণর নাচের সঙ্গে পণ্ডিত শিবকুমার শর্মা
ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজ়িক দেন। 'গাইড' ফিল্মে শচীন দেব বর্মণের সুরে লতাজী'র কণ্ঠে 'মোসে ছল কিয়ে
যায়ে' গানে তিনি তবলা সংগত করেন। 'ডর' ফিল্মে পুলিশের অপরাধীকে দৌড়ে ধরার প্রয়াস, এমন
একটি দৃশ্যে অনবদ্য তবলার ব্যবহার দৃশ্যটির থ্রিল কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। তিনি প্রিয় বন্ধু পণ্ডিত
হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার সঙ্গে একত্রে শিব-হরি নামে কয়েকটি ফিল্মে সুর দিয়েছেন। সিলসিলা, লমহে, ফাসলে, চাঁদনি, ডর।

পণ্ডিত শিবকুমার শর্মার প্রথম অ্যালবাম ১৯৬০ সালে। ১৯৬৭ সালে 'Call of the Valley'
হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া ও ব্রিজ ভূষণ কাবরাজী'র সঙ্গে শিবকুমার শর্মার অনবদ্য একটি অ্যালবাম।
১৯৮৬ সালে সংগীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার পান। ১৯৯১ পদ্মশ্রী, ২০০১ পদ্মবিভূষণে সম্মানিত
হন। Baltimore, USA সম্মানজনক নাগরিকত্ব পান তিনি।

১০ মে ২০২২ পণ্ডিত শিবকুমার শর্মার প্রয়াণে ১৪০০ সাল ওয়েবজিন এবং সম্পাদকের পক্ষ
থেকে আন্তরিক শ্রদ্ধা ও প্রণাম জানাই।